১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায়ের জন্য নতুন শুল্ক-কর বৃদ্ধি

টুইট ডেস্ক: ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব ঘাটতি কমাতে সরকার বিভিন্ন পণ্য ও সেবায় নতুন শুল্ক-কর বৃদ্ধি করেছে, যার ফলে রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে ১২ হাজার কোটি টাকা হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। গত ৯ জানুয়ারি সরকার মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যা ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে।

এই নতুন কর-শুল্ক বৃদ্ধির ফলে জীবনযাত্রার খরচ বাড়বে, বিশেষ করে মধ্যম ও নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের জন্য। বিভিন্ন জনপ্রিয় পণ্য ও সেবা, যেমন ফল, রান্নার গ্যাস, মুঠোফোন সেবা, ইন্টারনেট, পোশাক, এবং রেস্তোরাঁর খাবারে ভ্যাট এবং শুল্কের হার বাড়ানো হয়েছে।

এখন থেকে এসব পণ্যের উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, কিচেন টাওয়াল, টিস্যু, রান্নার গ্যাস, পোশাক এবং রেস্তোরাঁর খাবার এর অন্তর্ভুক্ত।

এছাড়া, মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের উপর ২০ থেকে ২৩ শতাংশ এবং ইন্টারনেট সেবা (আইএসপি) পরিষেবায় ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। শুল্ক-কর বৃদ্ধির ফলে ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বাড়বে কর ফাঁকির প্রবণতা।

ব্যবসায়ীদের মতে, শুল্ক ও করের পরিমাণ না বাড়িয়ে এর আওতা বাড়ানো উচিত ছিল, যাতে নন-কমপ্লায়েন্ট ব্যবসায়ীদের ভ্যাটের আওতায় আনা যায়।

বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন, “যেসব পণ্যের ওপর ট্যাক্স বেড়েছে, তাদের দাম বাড়বে, এবং মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব পড়বে। বাস্তবতায়, ‘প্রভাব পড়বে না’ এমন মন্তব্য অস্বীকার করা হয়েছে।” তবে, তিনি একে রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে দেখেছেন, কারণ রাজস্বে এখনও প্রবৃদ্ধি আসেনি।

সরকারের দাবি, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে ভোক্তাদের উপর অতিরিক্ত মূল্য চাপবে না, কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সরকারের এই দাবি বাস্তবতা থেকে দূরে।

এছাড়া, সিগারেটের দাম ও শুল্কের স্তরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা এবং উচ্চস্তরের সিগারেটের দাম ১২০ থেকে ১৪০ টাকায় পৌঁছাবে। এই পরিবর্তনের ফলে সিগারেটের বাজার থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রাখা হয়েছে।

এছাড়া, ব্যবসায়ীদের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে, যা পূর্বে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা ছিল। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এ ধরনের পরিবর্তন ব্যবসায়িক পরিবেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

অপরদিকে, উড়োজাহাজের টিকেটের দামও বাড়ানো হতে পারে, কারণ অভ্যন্তরীণ রুট ও সার্কভুক্ত দেশগুলোর টিকেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমান শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশের টিকেটের উপর শুল্ক দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১,০০০ টাকা করা হয়েছে।

সরকারের শুল্ক-কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পিছনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর চাপ রয়েছে। ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে আইএমএফ এই বাড়তি রাজস্ব আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে, যা সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে অর্জন করতে চায়।

সবমিলিয়ে, সরকারের এই শুল্ক-কর বৃদ্ধি নীতির ফলে ব্যবসায়ীরা, অর্থনীতিবিদরা এবং সাধারণ মানুষ সকলেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির এমন উচ্চতার সময়ে।

সরকারের প্রতি পরামর্শ:

সরকারের উচিত, ভ্যাট-কর ব্যবস্থাকে আরও সহজতর এবং ব্যবসাবান্ধব করা। সাধারণ ব্যবসায়ী যারা নিয়মিত ভ্যাট দেন না, তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করার পরিবর্তে করের আওতা বাড়ানো এবং সঠিকভাবে কর আদায় নিশ্চিত করা উচিত। পাশাপাশি, পণ্য ও সেবায় ভ্যাট কমিয়ে ব্যবসায়ীদের উপর আর্থিক চাপ কমানো যেতে পারে।

বর্তমান সময়ে মূল্যস্ফীতির উচ্চ হার সবার জন্য চাপ সৃষ্টি করছে, বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জন্য। সরকার যদি কিছু পণ্য ও সেবায় ভ্যাট কমানোর ব্যবস্থা নেয়, তবে ভোক্তাদের উপর বাড়তি চাপ পড়বে না। সরকারি নীতিমালা যদি ভোক্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করে, তাহলে এটি সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য ভাল হবে।

শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্তে সঠিক পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। সরকারি শুল্কের পরিমাণ বাড়ানোর পরিবর্তে, ব্যবসায়িক পরিবেশে সহজীকরণ এনে, বিভিন্ন খাতে ব্যবসায়ীদের জন্য উপযুক্ত শুল্ক প্রণালী তৈরি করা উচিত, যাতে তারা কর পরিশোধ করতে উৎসাহিত হন এবং ব্যবসায়িক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

নির্ধারিত আয়ের মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা প্রয়োজন, যাতে তাদের জীবনযাত্রার চাপ কিছুটা কমে। এসব মানুষজনের জন্য উপযুক্ত ভর্তুকি বা সহায়তা প্রদান, শুল্ক-কর বৃদ্ধির চাপ কমানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।

রাজস্ব আদায়ের এই পদক্ষেপগুলোর পাশাপাশি, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সরকার যদি কর সংস্কার এবং জাতীয় রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে, তবে ভবিষ্যতে আরো স্থিতিশীল অর্থনীতি তৈরি হবে, যা রাজস্ব ঘাটতি মোকাবেলা করতে সহায়ক হবে।