যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক: ১৯৭২ সালের স্বীকৃতি থেকে চলমান সহযোগিতা

টুইট ডেস্ক : সেক্রেটারি অব স্টেট উইলিয়াম রজার্সের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল। এছাড়া, ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মুখ্য কর্মকর্তা হার্বার্ট স্পাইভ্যাক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের একটি বার্তা হস্তান্তর করেন। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। জাা‌তির‌ পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ৯ এপ্রিল একটি চিঠি পাঠান যাতে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং ঢাকায় দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭২ সালের ১৮ই মে। হার্বার্ট ডি. স্পাইভ্যাক হন ভারপ্রাপ্ত চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স। ঢাকায় প্রথম অ্যামব্যাসেডর এক্সট্রাঅর্ডিনারি অ্যান্ড প্লেনিপটেনটিয়ারি ছিলেন ডেভিস ইউজিন বোস্টার। তিনি তার পরিচয়পত্র পেশ করেন ১৯৭৪ সালের ১৩ই এপ্রিল।

যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের ব্যাপারে অভিন্ন মতামত পোষণ করে। আমাদের বার্ষিক ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্ব সংলাপ’ অভিন্ন দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক লক্ষ্যসমূহকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে এবং চলমান ও আগামীর সহযোগিতামূলক কার্যক্রমকে কৌশলগত নির্দেশনা দেয়। ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারত্ব সংলাপ’ সম্মেলনে নানা ধরনের বিষয় আলোচিত হয়। এর মধ্যে ছিল: গণতন্ত্র ও সুশাসন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা। প্রতিনিধিদলগুলো টেকসই উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা, অভিবাসন ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অগ্রাধিকারগুলোর ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করতে কাজ করে। পঞ্চম সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৬ সালে, ওয়াশিংটন ডিসিতে।

১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ একটি অধিকতর সমৃদ্ধ ও বহুত্ববাদী সমাজ হয়ে ওঠার পথে উল্লেখযোগ্যরকম উন্নতি করেছে। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে এ দেশে ৬ শতাংশের বেশি হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১৩ সালে তৈরি পোশাক কারখানা রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশ তার গার্মেন্টস খাতে পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে উন্নতি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশে শ্রমিকের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন জোরদার এবং কর্মপরিবেশের নিরাপত্তার উন্নতি করার প্রচেষ্টায় এখনো সক্রিয়ভাবে যুক্ত। উন্নয়নের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় অর্জন থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্য, অবকাঠামোগত ঘাটতি, সুশাসন কাঠামোর দুর্বলতা এবং মানবসম্পদে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা এখনো বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বৃহত্তম রপ্তানি বাজার। দেশ দুটি দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। পাশাপাশি দ্বৈত কর এড়ানোর জন্যও চুক্তি করেছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ছিল ৪৬ কোটি ডলার, যা ২০১৬ সালের তুলনায় ০.৪ শতাংশ বেশি। দুই সরকারের মধ্যে ২০১৮ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বার্ষিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট (টিকফা) বৈঠক বাংলাদেশের সঙ্গে বৃহত্তর সহযোগিতার সম্ভাবনাকে তুলে ধরে। টিকফা বৈঠকের আলোচনায় বিশেষ করে বাংলাদেশের বাজারে যুক্তরাষ্ট্রের তুলার প্রবেশের সুযোগ, ডিজিটাল অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়া, সরকারি ক্রয়ে স্বচ্ছতা এবং বাংলাদেশে শ্রম সংস্কারের ওপর জোর দেওয়া হয়।

২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে প্রায় দেড়শ’ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল। এসময়ে দেশটি বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে প্রায় ৫শ’ ৭০ কোটি ডলারের পণ্য। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তার মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্য (খাদ্যশস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম এবং ভুট্টা), যন্ত্রপাতি এবং লোহা ও ইস্পাত পণ্য। আর যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি পণ্যের মধ্যে আছে তৈরি পোশাক, জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী ও কৃষিপণ্য। (সূত্র: ইউএসটিআর)

সম্প্রতি এই সহযোগিতা বার্ষিক ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোঅপারেশন ফোরাম’ এর চতুর্থ সভায় তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সভায় বাংলাদেশের সাথে বৃহত্তর সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার আলোচনা করা হয়েছে, যেগুলির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তুলার প্রবেশ, ডিজিটাল অর্থনীতি, এবং শ্রম সংস্কার।

বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র বিনিয়োগের মাধ্যমে স্থাপিত হতে এবং দুই দেশের মধ্যে সুবিধামুলক চুক্তিতে স্বাক্ষর হতে সহায়ক হতে হয়েছে। বাংলাদেশের বৃদ্ধির দিকে এই সম্প্রচারণ উদ্বুদ্ধ করেছে এবং দেশটি অর্থনৈতিক মাধ্যমে উন্নতি প্রবৃদ্ধি করতে সহায় করেছে।

সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী, চেয়ারম্যান, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেন, ইউরোপে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এতে দেশের শিল্পকারখানায় নতুন ক্রয়াদেশ কমে গেছে। আমরা বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী এখন যুক্তরাষ্ট্রমুখী হচ্ছি। সেখানকার অর্থনীতি ইউরোপের চেয়ে ভালো। সব মিলে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে রপ্তানি বাড়তে শুরু করবে। এর মধ্যেই দেশে শুরু হয়ে গেছে হরতাল, অবরোধ। একটা লম্বা সময় ধরে দেশে এসব ছিল না। অর্থনীতি ধীরে ধীরে উন্নতির দিকে যাচ্ছিল। এরপর মহামারি, যুদ্ধ মিলে বৈশ্বিক নানা কারণেই অর্থনীতি চাপে পড়েছে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এখন হরতাল, অবরোধ টানা চলতে থাকলে অর্থনীতির উন্নতির প্রক্রিয়া থেমে যাবে। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। তার মতে, দেশের চেয়ে রাজনৈতিক দল আগে হতে পারে না। দেশ টিকলে, দল টিকবে। সবার আগে দেশ, দুই দলকেই এটি বুঝতে হবে।

এদিকে সম্প্রতি রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করায় বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের ক্রয় মূল্য বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে পোশাক ক্রেতাদের যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈশ্বিক সংগঠন আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ)। বৃহস্পতিবার ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে পাঠানো এক ই-মেইল বার্তায় এই তথ্য জানিয়েছেন এএএফএর প্রধান নির্বাহী স্টিফেন লামার।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র দুটি দেশের সম্প্রচারণ এবং বিনিয়োগের মাধ্যমে তাদের সহযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এই সহযোগিতা সামাজিক, আর্থিক এবং রাজনৈতিক উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে এটাই জনগনের প্রত্যাশা।