দেশে তৈরি চিজ কমাচ্ছে বিদেশ নির্ভরতা

টুইট ডেস্ক: ইতালির দক্ষিণাঞ্চলে প্রথম শতাব্দীতে একটি বিশেষ ধরনের চিজ প্রথম তৈরি হয় বলে গল্প রয়েছে; যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত ওই এলাকাতেই শুধু পাওয়া যেতো। বিংশ শতাব্দীতে রেফ্রিজারেশন পদ্ধতি প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত বস্তুটি ওই অঞ্চলের বাইরে পাওয়া যেতো না। বর্তমানে অন্যতম পরিচিত একটি খাদ্যপণ্য মোজারেলা চিজের কথাই বলা হচ্ছে।

একসময় বাংলাদেশে এই চিজ আসতো বিদেশ থেকে। কিন্তু এখন দেশেই উৎপাদন হচ্ছে মোজারেলা চিজ। দেশের গরুর খামার ও দুধের রাজধানী খ্যাত সিরাজগঞ্জেই উৎপাদিত হচ্ছে এই চিজ। দেশে দুধের মোট চাহিদার সিংহভাগ আসে এই জেলা থেকে। সিরাজগঞ্জের পাশাপাশি পাবনা ও আশপাশের এলাকায় এমন কোনো বাড়ি পাওয়া যাবে না যেখানে গরুর খামার নেই।

এলাকায় কেউ নতুন বাড়ি করলে মানুষজন বলে, ‘বাড়ি তো বানাইলা, গরু কোই?’ এমনও অনেক গল্প আছে যেখানে গবাদি পশুকে সাথে ঘুমিয়েছেন ঘরের কর্তা। এমনই মায়া!

১৮৮২ সাথে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসক প্রতিনিধি লর্ড লিন-লিথডো প্রথমে এই এলাকায় গরু পালনে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা দেখতে পান। আর তাই সেই সময় তিনি উপমহাদেশের উন্নত ও ভালো মানের গরু এনে দেন। এখানকার খামারের আদি ইতিহাসে বড় অবদান রেখে গেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও।

১৮৯০ সালের দিকে জমিদারি তদারকির কাজে সফর করে এই এলাকা। গঠন করে দেন সমবায় সমিতি। দেন চারণভূমি। কৃষকদের এনে দেন ভালো জাতের ষাঁড় ও গাভী। যা দিয়ে পরবর্তীতে ‘পাবনা ব্রিড’ হিসেবে পরিচিত হয়। কবিগুরুর কাচারি বাড়ি আর চারণভূমি আজও সেই ইতিহাসের সাক্ষী।

সিরাজগঞ্জ জেলায় ছোট-বড় প্রায় ৩৩ হাজারের বেশি গরুর খামার রয়েছে। এসব খামারে গরু আছে ১৫ লাখের বেশি; যার প্রায় অর্ধেকই গাভী। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই জেলায় ছয় লাখ ৪০ হাজার টন দুধ উৎপাদিত হয়েছে। মিল্ক ভিটা, আড়ংসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন দুগ্ধ সংগ্রহকারী ও প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান খামারিদের কাছ থেকে দৈনিক প্রায় তিন লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। প্রতি লিটার দুধ গড়ে ৫৫ টাকা দরে কেনাবেচা হয়। সেই হিসাবে দৈনিক বিক্রি দাঁড়ায় এক কোটি ৬৫ লাখ টাকার ওপরে।

কেবল দুধ নয়, সিরাজগঞ্জ সুপরিচিত এখানকার পনির, ছানা ও ঘিয়ের জন্যেও। স্থানীয়রাই নিজস্ব উদ্যোগে খামারিদের কাছ থেকে দুধ সংগ্রহ করে এসব পণ্য তৈরি করেন। যা দামে ও মানে সকলের পছন্দের। করোনা মহামারীল আগে খামারের দুধ মূল পণ্য হলেও পরে মোড় ঘুরেছে।

করোনায় লকডাউনসহ নানা বাধায় চাহিদা কমে দুধের । বিপাকে পড়েন খামারিরা। আর সেই সময় কিছু খামারি শুরু করেন ছানা, ঘি ও পনির নিয়ে বড় পরিসরে কাজ করা। তাদের উদ্দেশ্য, নিজেদের তৈরি এই পণ্য অনলাইনে বিক্রির মাধ্যমে আরো বেশি ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেয়া।

এ নিয়ে আলাপ হয় শাহজাদপুরের বাঘাবাড়ী ঘাটের উদ্যোক্তা বসুদেব চন্দ্রের সাথে। ২০০২ সাল থেকে দুধ থেকে পনির, ছানা, ঘি তৈরি করছেন। যদিও তখন বিএসটিআই সনদ ছিলো না। ২০২১ সালে ‘অরুপ ছানা’ নামে নিয়েছেন সনদ। আজ তার বিক্রি আগের থেকে দ্বিগুনের বেশি বেড়েছে বলে জানালেন।

এদিকে আরেক উদ্যোক্তা শাহজাদপুরের হালুয়াঘাটির চিজ প্রস্তুতকারক আতাউর রহমান। তিনি মোজারেলা চিজ তৈরি করে বেশ সুনাম কুড়িয়েছেন। তার চিজ এখন দেশের সাথে বিদেশেও যাচ্ছে বলে জানালেন।

আড়াইশ’ গ্রামের চারটি মোজারেলা চিজের প্যাকেট বিক্রি করছেন এক হাজার টাকায়। যার মান নিয়ে খুশি ক্রেতারা। তিনি জানান, আগে কেবল মিষ্টি তৈরি করলেও এখন তিনি এই মোজারেলা চিজ নিয়ে বেশ আশাবাদী। চাহিদাও বেশি।

আরেক উদ্যোক্তা তৈরি করছেন দেশি ঘি। দুগ্ধজাত বিভিন্ন পণ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন এখানকার উদ্যোক্তারা। হিসাব বলছেন, প্রতি মাসে প্রায় ৩০ টন চিজ, তিন হাজার কেজি ঘিসহ বিভিন্ন পণ্য তৈরি করছেন একটি প্রকল্পের আওতাধীন উদ্যোক্তারা। এসব পণ্য বিক্রি করে বছরে তাদের আয় হয় প্রায় ১৩ কোটি টাকা।

খামার ও দুধ উৎপাদনে সরকারি প্রণোদনা রয়েছে। এবার দুগ্ধজাত অন্য পণ্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে নানা সংস্থাও। এর মধ্যে রয়েছে এনডিপি-এসইপি প্রকল্প। ২০১৯ সাল থেকে বিশ্বব্যাংক ও পিকেএসএফ দেশে টেকসই ও পরিবেশসম্মত ব্যবসা গড়তে ১৩ কোটি ডলারের ‘সাসটেইনেবল এন্টারপ্রাইজ প্রজেক্ট (এসইপি)’ শুরু করে।

সারাদেশে এই প্রকল্পের আওতায় রয়েছে ৬৮ উপ-প্রকল্প। তার একটি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলার এসইপি দুগ্ধজাত পণ্য উপপ্রকল্প অন্যতম। যা বাস্তবায়ন করছে বেসকারি সংস্থা ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি)। প্রশিক্ষন, ঋণ দিয়ে তারা সহযোগিতা করছেন উদ্যোক্তাদের। যার কারনে এসব পণ্যের উৎপাদনে আগ্রহী হচ্ছেন অন্যরাও। অনেকেই শহরের করপোরেট চাকরি ছেড়ে শুরু করছেন দুগ্ধজাত পণ্যের উৎপাদন।

সিরাজগঞ্জের এসইপি দুগ্ধজাত পণ্য উপপ্রকল্পের ব্যবস্থাপক আবদুল মালেক আকন্দ জানান, এ প্রকল্পের বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো উদ্যোক্তাদের বিএসটিআই সনদ করতে আগ্রহী করা। সেই চ্যালেঞ্চ উৎরে যাওয়ায় উৎপাদকরা এখন দাম ভালো পাচ্ছেন। দুগ্ধজাত পণ্যের পাশাপাশি বায়োগ্যাস, ট্রাইকো কম্পোস্ট সার ও সাইলেজ (গোখাদ্য) উৎপাদনে সহযোগিতা করা হচ্ছে বলেও তিনি জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, পিকেএসএফ এখন শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জ উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৭০০ উদ্যোক্তাকে নিয়ে কাজ করছে।

একসময় দুগ্ধজাত পন্য বলতে পনির, ঘি, ছানা, মিষ্টি থাকলেও এখন বৈচিত্র‌্য নিয়ে আসছেন উদ্যোক্তারা। প্রশিক্ষণ ও উন্নত কারখানা থাকায় এখন মোজারেলা চিজ নিয়েও কাজ করছেন এখানকার উদ্যোক্তারা। যা এখানকার দেশীয় বাজারে যেমন প্রভাব ফেলছে তেমনি বিদেশ থেকে আসা মোজারেলা চিজের ওপর নির্ভরতা কমাচ্ছে। অনলাইনেও বিক্রি করছেন তাদের এসব পণ্য।

আবদুল মালেক আকন্দ বলেন, ১৪ জন মোজারেলা চিজ উৎপাদক ছাড়াও শাহজাদপুর ও রায়গঞ্জে আরও অন্তত ১২০ জন দুগ্ধজাত পণ্যের উদ্যোক্তা রয়েছেন। তারা সবাই টেকসই পণ্য উৎপাদন পদ্ধতিতে গেলে এই এলাকার দুগ্ধজাত পণ্যের বার্ষিক বাজার ১২০ কোটি টাকা ছাড়াবে।