মিজলসের প্রাদুর্ভাবে আমেরিকার ৮,৫০০ স্কুল

ছবি : প্রতীকী

বিশ্ব ডেস্ক: মিজলসের ঝুঁকিতে আমেরিকার ৮,৫০০ স্কুল । মিজলস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানে মূলত ২০১৯ সালে ৪ মাসে সে সময় এই রোগে ৭১ জন শিক্ষার্থী আক্রান্ত হয়েছিল। সে সময়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা উল্লেখ করেছিলেন যে, ওয়াশিংটনের ক্লার্ক কাউন্টিতে সবগুলো শিশুর মধ্যে ৭৮ শতাংশ টিকার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।

সিডিসি জানিয়েছে, একটি কমিউনিটিকে মিজলস এর প্রাদুর্ভাব থেকে রক্ষা করতে হলে, সেখানকার অন্তত ৯৫ শতাংশ শিশুকে এর টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

ওয়াশিংটনের ক্লার্ক কাউন্টির ভ্যানকুভারের বাসিন্দা জেসিকা ফিচেলও ওই এলাকায় এই টিকার হার কম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।

এক পিতা জানান, অন্যান্যদের নিজেদের সন্তানের টিকা নিয়ে অসচেতনতার কারণে তিনি নিজেও তার ছেলের মিজলস এ আক্রান্ত হওয়া নিয়ে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা করতেন। তার ছেলেকে ২০১৯ সালের মিজলস প্রাদুর্ভাব এর সময় চাইল্ডহুড লিউকেমিয়ার জন্য কেমোথেরাপি দেয়া হয়।

ফিচেল জানান তিনি তার প্রতিবেশীদের মধ্যে এমন অনেকের পরিবারের কথাই জানতেন যারা তাদের সন্তানদেরকে মিজলস, মাম্পস ও রুবেলার ভ্যাকসিন না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তাদের অনেকের সন্তানই তার ছেলে কাই এর সঙ্গে খেলত যাকে তার দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য মিজলস এর টিকা দেয়া সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, ‘তাদের প্রতি আমার অনেক রাগ আছে। আমি কেবল এটাই বুঝতে পারিনা যে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ না থাকার পরও কেন আপনি এটি করবেন না?’

বার্তাসংস্থা সিবিএস নিউজ আমেরিকার ১৯ টি স্টেইটের হাজার হাজার পাবলিক ও প্রাইভেট স্কুলের তথ্য বিশ্লেষণ করেছে। তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে, অন্তত ৮,৫০০ টি স্কুলে শিশুদের মধ্যে মিজলসের টিকা নেয়ার হার ৯৫ শতাংশের কম।

স্কুলে শিশুদের টিকার হার কমে যাওয়ার বিষয়টি দেশজুড়ে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের জন্য উদ্বেগজনক। তাদের মধ্যে অনেকেই এটা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন যে, আরও অনেকেই এই কম টিকাদানের হারের কারণে মিজলসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই মাসের শুরুতেই ফিলাডেলফিয়ায় মিজলস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে। ওহায়ওতে ২০২২ সালে ৮২ জন শিশুর মিজলস এ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিল।

পেন স্টেইট ইউনিভার্সিটি এর জীববিজ্ঞানী ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ম্যাট ফেরারি বলেন, ‘আমি মনে করি মানুষ হিসেবে এই ব্যাপারটি আমার জন্য সতর্কতামূলক। জনসংখ্যার ঘনত্বের ওপরও এর প্রভাব পড়বে। যারা টিকা নেননি, তাদের সংস্পর্শে যতো বেশি মানুষ আসবেন ততোই এই রোগটি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে। এটি যতো বেশি হবে ততো এর প্রাদুর্ভাব হবে ও এটি দীর্ঘ সময় স্থায়ী হবে।’

‘ফেরারি জানান, প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধ করতে ও হার্ড ইমিউনিটি গড়ে তোলার জন্য উচ্চ মাত্রার টিকাদানের হার প্রয়োজন। কমিউনিটিতে হার্ড ইমিউনিটি বজায় থাকলে কাইয়ের মতো টিকা নেয়ার সক্ষমতা না থাকা শিশুরাও মিজলস সংক্রমণের হাত থেকে সুরক্ষা পাবে।’

ফেরারি বলেন, ‘যারা টিকা নিয়েছেন তারা আপনার আশেপাশে ঢালের মতো কাজ করে।’

সিবিএস নিউজের বিশ্লেষণ করা সিডিসি এর ডেটা অনুসারে, বেশিরভাগ কমিউনিটিতেই কম লোক এই প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করছে। অ্যামেরিকায় ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে প্রায় ৯৩ শতাংশ কিন্ডারগার্টেনারকে মিজলসের টিকা দেয়া হয়। কয়েক বছর আগে এই টিকাদানের হার ছিল ৯৫ শতাংশ।

ওয়াশিংটনের ক্লার্ক কাউন্টির অনেক স্কুলে শিশুদের টিকাদানের হার এর চেয়েও অনেক কম। মিজলস সংক্রমণের খবর পাওয়া গেছে এমন ১৬ টি স্কুল ও ডে কেয়ারে টিকার হার ৯০ শতাংশেরও কম ছিল। কিছু জায়গায় এই হার ৫০ শতাংশের মতো।

ভ্যানকুভারের সঙ্গে একই বছরে নিউ ইয়র্ক সিটিতেও মিজলস এর প্রাদুর্ভাব দেখা গেছে। এটি শেষ হওয়ার আগে ৬৪৯ জন মিজলসে সংক্রমিত হয়েছেন ও ডজনেরও বেশি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

নিউ ইয়র্কেও টিকাদানের হার কমে গেছে। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে সেখানকার কর্মকর্তারা বাসিন্দাদের জন্য টিকা না নিলে জরিমানার নিয়ম করতে বাধ্য হয়েছেন।

শহরের স্বাস্থ্য কমিশনার বলেছেন, শিক্ষামূলক কার্যক্রমের প্রচারণার সঙ্গে টিকার বাধ্যবাধকতা চালু করার ফলে ১১ মাস পর প্রাদুর্ভাব বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।

নিউ ইয়র্ক সিটির স্বাস্থ্য কমিশনার আশউইন ভাসান বলেন, ‘আমি মনে করি আমরা যেটা দেখেছি তা হলো, আমাদের হাতে থাকা সব বিকল্প ব্যবহার করতে হবে। কিছু সময় চাপ প্রয়োগ করাটা নির্দিষ্ট পরিবেশে কাজ করে বিশেষ করে প্রাদুর্ভাব ও জরুরি ক্ষেত্রে। এটা নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করাও জরুরি যাতে কম টিকাদানের হার নিয়ে কমিউনিটিগুলোর সঙ্গে কথা বলা যায়।’

‘সিডিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাদুর্ভাব শেষ হওয়ার পরপরই নিউ ইয়র্ক শহরে টিকাদানের হার বেড়ে ৯৬.৬ শতাংশ হয়ে যায়। তবে তা ২০১৮ সালে ছিল ৯৮.৮ শতাংশ।’

ভাসান জানিয়েছেন, এভাবে টিকাদানের হার কমে যাওয়ার বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগজনক। তিনি বলেন, ‘কম টিকাদানের হার থাকা কমিউনিটিগুলো ছোট ছোট গর্তের মতোই। আমি মনে করি, সংবেদনশীল কমিউনিটিগুলোকে লক্ষ্য করে এটা শক্তিশালী সমর্থন প্রাপ্ত বিজ্ঞান ও টিকা বিরোধী প্রচারণার ফল। ’

ভাইরাসটির পূর্ণ বৈজ্ঞানিক নাম মিজল্‌স মর্বিলিভাইরাস (Measles morbillivirus)। হাম  একটি অত্যন্ত ছোয়াঁচে ও তীব্র ভাইরাসঘটিত রোগ।

১৭৫৭ সালে ফ্রান্সিস হোম নামক একজন স্কটীয় চিকিৎসক রোগীর রক্তে উপস্থিত একটি সংক্রামক জীবাণুর কারণে যে হাম রোগটি হয়, তা প্রমাণ করেন।

১৯৫৪ সালে মার্কিন চিকিৎসক জন এন্ডার্স ও টমাস পিবলস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের বস্টন নগরীতে হামে আক্রান্ত রোগীদের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে সেখান থেকে হামের ভাইরাসটিকে পৃথক করতে সক্ষম হন। হামের ভাইরাসটি একটি একসূত্রবিশিষ্ট, ঋণাত্মক-দিকমুখী, আবরণীবিশিষ্ট, অখণ্ডিত আরএনএ ভাইরাস।

ভাইরাসটির ২৪টি প্রকারণ থাকা সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে, তবে বর্তমানে মাত্র ৬টি প্রকারণ মানবজাতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মানুষ ভাইরাসটির স্বাভাবিক পোষক; মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর হাম হয় না।