যুদ্ধের এক মাসে মৃত্যু আর ক্ষুধার বিভীষিকাসহ যা যা ঘটছে গাজায়

টুইট ডেস্ক : গাজা- ইসরায়েলের রক্তাক্ত সংঘাতের এক মাস পূর্ণ হলো আজ। গত সাতই অক্টোবর ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকে গাজায় ক্রমাগত পাল্টা আক্রমন করতে থাকে ইসরায়েল।

গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলা এতোটাই তীব্র রূপ নেয় যে, গত এক মাসে ওই উপত্যকায় যতো হতাহত হয়েছে তা ২১ মাসে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের হতাহতের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। খবর- বিবিসি বাংলা

সাতই অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলের অব্যাহত বিমান হামলায় এখনো পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে এক চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে গাজার অন্তত ২০ লাখ মানুষ। হামলা থেকে বাঁচতে সবাই দক্ষিণের পথে পা বাড়ালেও জাতিসংঘ বলছে গাজার কোন জায়গায়ই নিরাপদ নয়।

এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত পার হয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ারও কোন সুযোগ নেই এই লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষের। মিশরের সীমান্ত ঘেঁষা রাফাহ ক্রসিংও খোলা হচ্ছে শর্ত সাপেক্ষে। এমন পরিস্থিতিতে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকটে অবরুদ্ধ গাজার লাখ লাখ মানুষ এক প্রকার মৃত্যুর প্রহর গুনছেন।

ইহুদীদের বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান সুকত শেষ হবার পরপরই ৭ই অক্টোবর ভোর থেকে হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজা অঞ্চল থেকে ইসরায়েলের দিকে রকেট হামলা শুরু করে। এরিমধ্যে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের বেশ কিছু অস্ত্রধারী দক্ষিণ ইসরায়েলে ঢুকে পড়ে।

এজন্য শুরুতে তারা সীমান্ত বেষ্টনীতে থাকা পর্যবেক্ষণ সরঞ্জামে ড্রোন হামলা চালায়। এরপর বিস্ফোরক এবং যানবাহন ব্যবহার করে নিরাপত্তা বেষ্টনীর অন্তত ৮০টি জায়গা ভেঙে তারা ইসরায়েলে প্রবেশ করে।

এসব কাজে মোটর চালিত হ্যাং-গ্লাইডার অর্থাৎ অনেকটা প্যারাসুটের মতো দেখতে মানববাহী বাহন এবং মোটরবাইকও ব্যবহার করে তারা। এভাবে গাজা থেকে হাজারো সশস্ত্র হামাস সদস্য একাধিক স্থানে ছড়িয়ে পড়ে এবং আক্রমণ চালাতে শুরু করে।

হামাস যোদ্ধাদের মধ্যে একটি অংশ বেসামরিক মানুষদের লক্ষ্য করে হামলা চালায় এবং অন্যরা সামরিক ফাঁড়িগুলো লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এরপর তারা ইসরায়েল থেকে ২০০ জনেরও বেশি মানুষকে বন্দি করে সীমান্তের সুড়ঙ্গ পথগুলো দিয়ে গাজা উপত্যকায় নিয়ে যায়।

অসমর্থিত কিছু ভিডিওতে দেখা যায় ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের ধরে মোটর বাইকে করে গাজার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

হামাসের এত বড় পরিকল্পিত হামলা কিভাবে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়িয়ে গেল, সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার কোন ব্যক্তিগত দায়ভার স্বীকার করেননি ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে তিনি এ নিয়ে ভীষণ চাপের মধ্যে আছেন।

গত ২৯শে অক্টোবর তার একটা এক্স বার্তা বা সাবেক টুইটার বার্তা আলোচনার ঝড় তোলে। যেখানে তিনি গোয়েন্দা সংস্থাকে এই ঘটনায় অভিযুক্ত করেন। তবে পরে মি. নেতানিয়াহু টুইটটি মুছে দেন ও ক্ষমা চান।
হামাসের হামলার ঘটনায় প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা নজরদারি।

ইসরায়েলে হামাস হামলা চালানোর পরপরই গাজা উপত্যকা লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালাতে শুরু করে তেল আবিব। গাজায় স্থল অভিযান চালাতে গাজা সীমান্তে লাখ লাখ পদাতিক সেনা, সাঁজোয়া সেনা, আর্টিলারি সৈন্যদল মোতায়েন করা হয়।

টানা এক সপ্তাহ ধরে গাজায় বিমান হামলার পর, অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে ইসরায়েলের পদাতিক বাহিনী ও ট্যাঙ্ক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলার উদ্দেশ্যে গাজা উপত্যকায় প্রবেশ করে। তবে আনুষ্ঠানিক স্থল অভিযান বা যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘোষণা আসে ২৮শে অক্টোবর। অর্থাৎ হামলা শুরুর ২১ দিন পর।

ওইদিন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক টেলিভিশন ভাষণে ঘোষণা দেন, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযান দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।

নেতানিয়াহু ওই টেলিভিশন ভাষণে বলেন, “আমরা যুদ্ধ করব, আমরা স্থলে বা আকাশে কোথাও সৈন্য প্রত্যাহার করব না।”

পশ্চিমা দেশ ও আরব বিশ্বের মিত্ররা ইসরায়েলের পাশে আছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের এই যুদ্ধকে তিন স্তরে ভাগ করার কথা জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট।

তিনি বলেছেন, “প্রথম পর্যায়ে অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল, হামাসকে পরাজিত ও ধ্বংস করার জন্য তাদের অবকাঠামো ধ্বংস করা। দ্বিতীয় পর্যায়ে ইসরায়েলি সেনারা, হামাস সদস্যদের খুঁজে বের করে তাদের নির্মূল করতে ক্রমাগত লড়াই চালিয়ে যাবে।”

এবং তৃতীয় পর্যায়ে, “ইসরায়েলের নাগরিকদের জন্য নতুন করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে,” গ্যালান্ট বলেন।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে যে, সাতই অক্টোবরের হামলার পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ এক হামাস নেতাকে তারা হত্যা করেছে। বিবিসি যুদ্ধক্ষেত্রে এই নিহত হওয়ার খবর এককভাবে যাচাই করতে পারেনি। এ বিষয়ে হামাস এখনও কোন মন্তব্য করেনি।

এদিকে, গাজায় হামলা অব্যাহত থাকায় হামাসের হাতে জিম্মি ব্যক্তিদের মুক্তির বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে। হামাস এ পর্যন্ত কয়েকজন জিম্মিকে মুক্তি দিলেও এখনও বেশিরভাগ তাদের হাতে বন্দি রয়েছে।

নেতানিয়াহু হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের পরিবারের সাথে দেখা করেছেন, যারা গাজায় তীব্র হামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। হামাস মূলত এই জিম্মিদের বিনিময়ে ইসরায়েলের কারাগারে থাকা সব ফিলিস্তিনি বন্দীর মুক্তির প্রস্তাব দেয়।

ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ড্যানিয়েল হাগারি বলেছেন, সেনারা গাজায় প্রবেশ করে উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে এবং কার্যতভাবে তারা গাজা উপত্যকাকে উত্তর গাজা এবং দক্ষিণ গাজা, এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে।

ইসরায়েল এখন গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যেতে বাসিন্দাদের জন্য একটি ‘করিডোর’ খোলা রেখেছে বলে তিনি জানান।

গাজা শহরকে একটি “যুদ্ধক্ষেত্র” ঘোষণা দিয়ে বাসিন্দাদের দক্ষিণে চলে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কীকরণ লিফলেটও ফেলা হয়েছে।

উত্তর গাজা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হলেও সেখানে এখন সাড়ে তিন থেকে চার লাখ লোক অবস্থান করছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজার দক্ষিণাঞ্চলেও হামলা চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে গাজার কোন অংশই এখন নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

এদিকে ইসরায়েল ঘোষণা করেছে তারা হামলা আরও জোরদার করবে এবং গাজা উপত্যকা এবং গাজা শহর ঘিরে স্থল অভিযানও আরও শক্তিশালী করা হবে।

এমন অবস্থা দেখে গাজায় অবস্থানরত বিবিসির সংবাদদাতা রুশদী আবু আলুফ মনে করছেন, ইসরায়েলি বাহিনী এভাবে গাজার বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে কোণঠাসা করতে চাইছে এবং গাজা শহরকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চালাচ্ছে।

এদিকে ইসরায়েলি হামলা থেকে রক্ষা পায়নি হাসপাতালও। অক্টোবরের মাঝামাঝি গাজার আল–আহলি আরব নামের হাসপাতালে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। সেইসাথে আল কুদস ও আল শিফা হাসপাতালের আশেপাশেও তারা হামলা চালায়।

গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত সাতই অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে ইসরায়েলের অব্যাহত বিমান হামলায় এখনো পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী ও শিশু।

যদিও ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই হিসাব বিশ্বাস করে না।

দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ফিলিস্তিনি শাখার কর্মকর্তা জেসন লি গাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, সেখানে প্রতি ১০ মিনিটে একটি করে শিশু মারা যাচ্ছে। সেইসাথে যতো মানুষ আহত হয়েছে তাদের প্রতি তিন জনের মধ্যে একজন শিশু।

এদিকে জাতিসংঘের হিসেবে ২১ মাস আগে রাশিয়ার পুরো মাত্রায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর প্রায় ৯৭০০ জন বেসামরিক নাগরিক সেখানে মারা গিয়েছে।

সে হিসেবে দেখা যায় রাশিয়ায় ২০২২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে যতজনকে হত্যা করেছে, ইসরায়েলিরা এই এক মাসে তার চাইতেও বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের হত্যা করেছে। জাতিসংঘ আরও জানিয়েছে ইউক্রেনে হতাহতের এই হিসাবটি অসম্পূর্ণ এবং বেসামরিক নাগরিক মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে।

গাজা ও ইসরায়েলের এই নজিরবিহীন সংঘাতময় পরিস্থিতিতে বিশ্বে কার্যত দুটি শিবিরে ভাগ হয়ে গিয়েছে। কেউ সরাসরি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে, আবার কেউ ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলছে। আবার কারও বক্তব্যে ফুটে উঠেছে ‘নিরপেক্ষ অবস্থানের’ কথা। সবশেষ আরব দেশগুলো গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবি জানায়।

তবে যুক্তরাষ্ট্র সতর্ক করছে যে যুদ্ধবিরতি হলে হামাস পুনরায় সংগঠিত হবে, এবং আবারো সাতই অক্টোবরের মতো হামলা চালাতে পারে সংগঠনটি।

অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র গাজায় এখনই কোন যুদ্ধবিরতি চায় না। তবে দেশটি গাজায় একটি মানবিক বিরতির বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

যুদ্ধবিরতি আর মানবিক বিরতির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল মানবিক বিরতি অপেক্ষাকৃত কম সময়ের জন্য কার্যকর হয়। কখনো কয়েক ঘণ্টার জন্যও কার্যকর করা হয়ে থাকে মানবিক বিরতি।

শুধুমাত্র মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করার জন্যই মানবিক বিরতি আহ্বান করা হয়ে থাকে।

এই মানবিক বিরতির বিষয়ে আরব দেশগুলোর সমর্থন আদায়ে সৌদি আরব, জর্ডান, ইরাক ও তুরস্কে সফর করেছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন।

আম্মানে লেবানন, কাতার, জর্ডান, মিশর, সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সেখানে আরব রাষ্ট্রগুলো মানবিক বিরতির পরিবর্তে জরুরী অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব আনেন।

মানবিক বিরতির বিষয়ে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সাথেও বৈঠক করেন ব্লিংকেন। কিন্তু নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দেন, ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত গাজায় হামাসের সঙ্গে সাময়িক যুদ্ধবিরতি হবে না। হামলা চলবে।

হামাসের হামলার একেবারে প্রথম দিন থেকে ইসরায়েল সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে হামাসকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও সেটিতে সমর্থন দিয়েছেন।

তবে তিনি এটাও যুক্ত করেন যে ‘সঠিক পন্থায়’ এটি করতে হবে। যার মানে তিনি বুঝিয়েছেন যে ইসরায়েলকে বেসামরিক নাগরিক রক্ষায় যুদ্ধের নীতি মেনে চলতে হবে।

এ বিষয়ে বিবিসির সংবাদদাতা জেরেমি বোয়েন বলেন, তিনি গত ৩০ বছরে ইসরায়েলের সবগুলো যুদ্ধে রিপোর্ট করেছেন। কিন্তু আমার মনে পড়ে না যে যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রশাসক এভাবে প্রকাশ্যে বলছে ইসরায়েলকে যুদ্ধের নীতি মেনে চলতে। ব্লিংকেনের সফর ইঙ্গিত দেয় যে তার বিশ্বাস ইসরায়েলিরা বাইডেনের পরামর্শ মানছে না।

এদিকে লেবাননের শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী হেজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহ, গাজায় চলমান সংঘাত ও বেসামরিক নাগরিক মারা যাওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্র দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, “গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা চলতে থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে।“

তবে লেবাননের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল এবং সেখানকার সবচেয়ে বড় সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে কিনা, সে বিষয়ে তিনি কোন ইঙ্গিত দেননি।

এদিকে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইপ এরদোয়ান ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনেন। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে অবিলম্বে মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।

মানবিক সহায়তার জন্য গাজা উপত্যকায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২৭শে অক্টোবর একটি প্রস্তাব পাস হয়। আরব দেশগুলোর পক্ষে সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবটি উত্থাপন করে জর্ডান। এ সময় প্রস্তাবের পক্ষে ১২০টি দেশ এবং বিপক্ষে ১৪টি দেশ ভোট দেয়। এছাড়া ভোটদানে বিরত ছিল ৪৫টি সদস্য দেশ।

গৃহীত এই প্রস্তাবে হামাসের কাছে জিম্মি বেসামরিক ব্যক্তিদেরকে অবিলম্বে “নিঃশর্ত মুক্তি” দেওয়ারও আহ্বান জানানো হয়। ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডাব্লিউএ জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গাজায় জাতিসংঘের ৪৮টি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সংস্থাটি বলেছে যে, গাজার ১৫ লাখ বাসিন্দা বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকই তাদের স্থাপনায় আশ্রয় নিয়েছে।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলোয় ইতোমধ্যে ধারণ ক্ষমতার চাইতে বেশি মানুষ অবস্থান নিয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে নতুন করে আর কাউকে আশ্রয় দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এমন অবস্থায় এসব স্থাপনাগুলোর কাছে রাস্তাতেই বাধ্য হয়ে অনেক মানুষ ঠাঁই নিয়েছে।

অল্প জায়গায় এতো মানুষ গাদাগাদি করে থাকায় “গুরুতর স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা ঝুঁকি” সৃষ্টি হয়েছে এবং সবাইকে সেবা দেয়া রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

বিশেষ করে ইসরায়েলের হামলায় বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং পয়ঃনিষ্কাশন অবকাঠামোর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছে।

সেভ দ্য চিলড্রেন জানিয়েছে, গাজায় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধের তীব্র সংকট দেখা দেয়ায়, সার্জনরা অ্যানেসথেটিক অর্থাৎ অবশ করার ওষুধ ছাড়াই অস্ত্রোপচার করছেন, হাসপাতালগুলোতে আলোর উৎস হিসেবে মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে মানুষ। এমনকি ব্যান্ডেজও ফুরিয়ে গিয়েছে। সেইসাথে খাদ্য, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটেও মানবেতর অবস্থায় দিন পার করছে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ মানুষ।

এদিকে, গাজায় এখন টেলিফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছেই বলা যায়। এই ব্ল্যাকআউটের কারণে গাজার “গণ-নৃশংসতা” ঢাকা পড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ গবেষক ডেবোরা ব্রাউন।

এর আগে, দ্য কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টম (সিপিজে) গাজার তথ্য যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছে। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে যে, এটি করা না হলে ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের সবটুকু চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হবে না। এর ফলে এই যুদ্ধকে ঘিরে নানান প্রোপাগান্ডা ও গুজব ছড়ানোর ঝুঁকি তৈরি হবে বলেও আশঙ্কা করছে সংগঠনটি।

এদিকে হামলার মধ্যে যোগাযোগ করতে না পারলে মধ্যে যাদের জরুরী ভিত্তিতে চিকিৎসা দরকার তারা হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্সের সাথে যোগাযোগ করতে পারবে না বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম ঘেব্রেয়েসুস। এজন্য “যোগাযোগের সব চ্যানেল জরুরি ভিত্তিতে চালু করা উচিত” বলে তিনি জানান।

গাজায় সর্বাত্মক অবরোধ ঘোষণার এ সপ্তাহের মাথায় ইসরায়েল ওই উপত্যকায় বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২১শে অক্টোবর প্রথমবারের মতো মিশরের রাফাহ সীমান্ত দিয়ে গাজায় ত্রাণ প্রবেশ করতে শুরু করে।

তবে ত্রাণবাহী মাত্র ২০টি ট্রাককে প্রবেশের অনুমতি দেয় ইসরায়েল। ওইসব ট্রাকে খাবার, পানি ও ওষুধ ছাড়াও কফিন ছিল। জাতিসংঘ বলছে, এই ট্রাকগুলোতে পৌঁছানো মানবিক সহায়তার পরিমাণ গাজার প্রয়োজনের অনুপাতে খুবই সামান্য।

দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের ফিলিস্তিনি শাখার কর্মকর্তা জেসন লি বলেছেন, “গাজায় যে ত্রাণ সহায়তা দেয়া হচ্ছে তা মহাসমুদ্রে এক ফোঁটা পানির মতো।“

এদিকে বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে গাজায় চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধ দিয়েছে জর্ডান। রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি অবলম্বে গাজায় সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। সংস্থাটি গাজায় ত্রাণ সহায়তা সরবরাহের জন্য বার বার গাজায় প্রবেশের আবেদন জানিয়ে আসছে।

সাম্প্রতিক এই সংঘাতময় পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বিবিসির সংবাদদাতা একটি বিষয় স্পষ্ট করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে থাকা ইসরায়েল এমন কোন চুক্তিতে যাবে না যা হামাসকে ক্ষমতায় রাখবে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ অনেকেই বলেছেন, যুদ্ধ এড়ানোর একমাত্র উপায় হল ইসরায়েলের পাশাপাশি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। কিন্তু উভয় দিকে এখন যে নেতৃত্ব আছে তাদের দ্বারা এটা সম্ভব নয়।

আর দুই পক্ষের বোঝাপড়ার মাধ্যমে এই সংঘাতের অবসান না হলে, দুই দিকের আরো অনেক প্রজন্ম যুদ্ধের মুখোমুখি হবে, এমন আশঙ্কাই থেকে যায় বলে বিবিসির সংবাদদাতা মনে করেন।