বম জনগোষ্ঠীর পুনরুদ্ধারে সেনাবাহিনীর ইকো রিসোর্ট উদ্যোগ

কেএনএফ সংঘর্ষে বাস্তুচ্যুত বম সম্প্রদায়ের মানুষের কর্মসংস্থানে সেনাবাহিনীর মানবিক উদ্যোগ। সুংসং পাড়ায় ‘আলা মি ত্লাং লা’ ইকো রিসোর্ট নির্মাণ শুরু।

অসীম রায় (অশ্বিনী): কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সঙ্গে সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্ত বান্দরবানের বম সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন-জীবিকা পুনরুদ্ধারে এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে রুমা উপজেলার দুর্গম পাহাড়ি গ্রাম সুংসং পাড়ায় একটি ইকো রিসোর্ট নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে।

২৭ ডিসেম্বর বান্দরবান সেনা রিজিয়নের রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এস এম রাকিব ইবনে রেজওয়ান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে ইকো রিসোর্টটির নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী শুধু পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণেই নয়, বরং পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপদ খাবার পানির সংকট সমাধানেও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

রিজিয়ন কমান্ডার আরও বলেন, ভবিষ্যতে যাতে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এই এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে না পারে, সে লক্ষ্যে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। সন্ত্রাসীদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া হবে না বলেও তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

বান্দরবানের রুমা উপজেলার কেওক্রাডং পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সুংসং পাড়া। প্রায় এক বছর আগে কেএনএফের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষের সময় আতঙ্কে বম সম্প্রদায়ের মানুষজন পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সে সময় পুরো গ্রামটি কার্যত জনশূন্য হয়ে পড়ে।

বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় ধীরে ধীরে গ্রামে ফিরছেন বাস্তুচ্যুতরা। পালিয়ে যাওয়া মানুষ ফিরে আসায় আবারও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরেছে সুংসং পাড়ায়। ঘরবাড়ি, কৃষিকাজ ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা আগের অবস্থায় ফেরার চেষ্টা চলছে।

গ্রামবাসীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সেনাবাহিনীর সহায়তায় এই ইকো রিসোর্ট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রিসোর্টটির নাম রাখা হয়েছে ‘আলা মি ত্লাং লা’, যার বাংলা অর্থ—দূর পাহাড়ের গান। এটি নির্মাণ হলে স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২১০০ ফুট উচ্চতায় প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ১৬ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট রিসোর্টটি নির্মাণ করছে। সেনাবাহিনীর প্রকৌশল ও তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে।

রিসোর্টটি চালু হলে রুমা থেকে পর্যটকরা বগালেক ও কেওক্রাডং হয়ে সুংসং পাড়া এবং ডাবল ফলসসহ আশপাশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করতে পারবেন। এটি দেশের সর্বোচ্চ সড়ক যোগাযোগের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন রুট হিসেবেও পরিচিতি পাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেনাবাহিনীর ১৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল আতিকুল করিম, রুমা জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মো. মেহেদী হাসান সরকার, জেলা পরিষদের সদস্য ও বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজার লম বমসহ সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও বম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ।

কেএনএফের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে দুই সহস্রাধিক বম সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ ভারতের মিজোরামে আশ্রয় নেন। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ২০২ পরিবারের ৫০৩ জন আবারও নিজ নিজ গ্রামে ফিরে এসেছেন। তবে দীর্ঘদিন কর্মসংস্থানের অভাবে তারা নানামুখী সংকটে পড়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের মতে, পর্যটন শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি এই ইকো রিসোর্ট স্থানীয় বম সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাহাড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগ একটি টেকসই দৃষ্টান্ত হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।