পাহাড়, ঝর্ণা আর মেঘের হাতছানি: বেড়াতে আসুন রূপের রাণী বান্দরবানে

পাহাড়, ঝর্ণা, মেঘ আর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অনন্য মিলনমেলা
অসীম রায় (অশ্বিনী), বান্দরবান: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ রূপে সজ্জিত পাহাড়ি জেলা বান্দরবান যেন সত্যিই রূপের রাণী। উঁচু–নিচু সবুজ পাহাড়, মেঘে ঢাকা শৃঙ্গ, ঝর্ণার কলকল ধ্বনি আর নদীর নীল জলরাশি—সব মিলিয়ে প্রকৃতির এক অনিন্দ্যসুন্দর লীলাভূমি এই জেলা।
দেশের সর্বোচ্চ পাহাড় কেওক্রাডং, তাজিংডংসহ অসংখ্য জলপ্রপাত ও খুমের কারণে প্রতিবছর সারাদেশ থেকে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমান এখানে।
পাহাড়, নদী, ঝর্ণা আর ঐতিহ্যবাহী স্থান একসঙ্গে উপভোগ করার সুযোগ থাকায় দার্জিলিং শহরের অন্যতম পর্যটন স্পট হিসেবে বান্দরবানের খ্যাতি রয়েছে। একই সঙ্গে এই জেলায় বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বাঙালিসহ মোট ১২টি সম্প্রদায়ের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি পর্যটকদের কাছে বাড়তি আকর্ষণ তৈরি করেছে।
পর্যটকদের জন্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে চিম্বুক–নীলগিরি ও মেঘলা–নীলাচল সড়কে চালু হওয়া ছাদখোলা বাস। ফলে পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে দিতে পর্যটকরা প্রকৃতির সৌন্দর্য আরও কাছ থেকে উপভোগ করতে পারছেন।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি জানান, বৈচিত্র্যময় জেলা বান্দরবানে পর্যটন শিল্পের বিকাশে প্রান্তিক লেক পর্যটন স্পটকে আরও আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা হচ্ছে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এখানে নেপাল থেকে আমদানি করা অ্যাডভেঞ্চার ট্রি–টপ, জিপ–লাইন ট্রলি (জিপলাইনার) এবং শিশুদের জন্য কিডস কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। প্রকৃতির নির্মল বাতাস, পাখির কিচিরমিচির আওয়াজে ভরপুর এই স্থানটি পিকনিক ও যেকোনো সামাজিক আয়োজনের জন্য আদর্শ একটি দর্শনীয় স্পট।
পর্যটকে মুখর বান্দরবানের দর্শনীয় স্থানগুলো
এবারের ছুটিতেও বান্দরবানের মেঘলা, নীলাচল, শৈলপ্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি, প্রান্তিক লেক, দেবতাখুম, সাতভাইখুম, মাথাভরাখুম, ঋজুক ঝর্ণা, আমিয়াখুম জলপ্রপাত, ভেলাখুম, মিলনছড়ি, পিক–৬৯, ডিম পাহাড়সহ জেলার মোট ৪৬টি দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে।
পর্যটকদের অনুভূতি
রংপুর থেকে বান্দরবানের মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রে বেড়াতে আসা পর্যটক মৌ রায় বলেন, “বান্দরবান খুবই সুন্দর একটি জেলা। ছুটি পেলেই আমি পরিবার–পরিজন নিয়ে এখানে ঘুরতে আসি।”
বরিশাল থেকে নীলাচল ঘুরতে আসা পর্যটক সুমনা পাল জানান, “পাহাড়, প্রকৃতি আর মেঘের অপরূপ জেলা বান্দরবান। বাংলাদেশের কয়েকটি সেরা পর্যটন এলাকার মধ্যে এটি অন্যতম। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বসবাস আর প্রকৃতির সৌন্দর্য যে কাউকে সহজেই মুগ্ধ করে।”
হোটেল–মোটেলে বেড়েছে পর্যটকের চাপ
পর্যটন মৌসুমে বিনোদন কেন্দ্রের পাশাপাশি জেলার হোটেল–মোটেলগুলোতেও বেড়েছে পর্যটকদের সমাগম। বান্দরবান হোটেল রিসোর্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম জানান, বান্দরবানে পর্যটকের আগমন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অধিকাংশ হোটেল–মোটেলে পর্যটকের উপস্থিতি বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, “পর্যটকরা যেন সর্বোচ্চ সেবা পান, সে বিষয়ে আমরা নিয়মিত সদস্যদের নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছি।”
নিরাপত্তায় প্রশাসনের কঠোর নজরদারি
পর্যটকদের নিরাপদ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিনিয়া চাকমা জানান, ছুটিতে পর্যটক আগমন বেড়েছে এবং আগত পর্যটকদের নিরাপত্তায় টুরিস্ট পুলিশের পাশাপাশি জেলা পুলিশের সদস্যরা নিরলসভাবে কাজ করছেন।
পর্যটনকেন্দ্রের টিকিট কাউন্টার ইনচার্জরা জানান, প্রতিদিন কয়েক হাজার পর্যটক বিভিন্ন স্পটে ভ্রমণ করছেন এবং আগামী কয়েক দিনে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
বান্দরবানের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ
নীলাচল: সদর থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এখান থেকে পাহাড়, নদী ও কক্সবাজার উপকূলের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়।
নীলগিরি: প্রায় ৪ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত ‘মেঘের দেশ’। সূর্যোদয় ও হেলিপ্যাড এখানকার প্রধান আকর্ষণ।
চিম্বুক পাহাড়: বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত। মেঘে ভেসে থাকা অনুভূতির জন্য বিখ্যাত।
মিলনছড়ি ও শৈলপ্রপাত: শহরের কাছেই অবস্থিত ঝর্ণা, যেখানে স্বচ্ছ ও ঠান্ডা পানির সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
বগালেক: নীল পানির লেকের জন্য বিখ্যাত, শীতকালে ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত।
বুদ্ধ ধাতু জাদি (স্বর্ণ মন্দির): দেশের অন্যতম প্রধান বৌদ্ধ মন্দির, মায়ানমারের কারিগরদের নির্মিত।
তিন্দু (বাংলাদেশের নায়াগ্রা): সাঙ্গু নদী ও পাহাড়ঘেরা এক রহস্যময় জলপ্রপাত।
কেওক্রাডং: ৩ হাজার ১৭২ ফুট উচ্চতার পাহাড়, সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় পর্যটকদের বিশেষ আকর্ষণ।
জাদিপাই ও নাফাখুম জলপ্রপাত: বান্দরবানের সবচেয়ে নান্দনিক ও জনপ্রিয় জলপ্রপাতগুলোর মধ্যে অন্যতম।
চিম্বুক–নীলগিরি ও মেঘলার পাশে সৎসঙ্গ বিহার ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে। নীলাচল পথে পর্যটকদের জন্য ছাদখোলা বাস চালু হওয়ায় ভ্রমণ আরও আনন্দদায়ক হয়েছে।
সব মিলিয়ে পাহাড়, মেঘ, ঝর্ণা আর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির টানে এখনই বন্ধু কিংবা প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন রূপের রাণী বান্দরবানে।









