বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত হস্তক্ষেপ করছে না: হাইকমিশন

ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না: নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের স্পষ্ট বিবৃতি।
রাজনৈতিক উত্তেজনা, প্রত্যর্পণ ইস্যু ও আঞ্চলিক কূটনীতিতে নতুন মাত্রা।
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি ঘিরে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মধ্যে নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন একটি স্পষ্ট বিবৃতি দিয়েছে।
শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, তবে দেশটির রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করছে না। কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা তাদের এক প্রতিবেদনে এই বিবৃতির উল্লেখ করেছে।
গণঅভ্যুত্থান ও ক্ষমতার পরিবর্তন
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হয়।
সর্বশেষ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দিলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এর পরপরই বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের কাছে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ দাবি জানায়। তবে এ বিষয়ে ভারত এখনো প্রকাশ্য ও স্পষ্ট কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
হাইকমিশনের বক্তব্য ও সাম্প্রতিক সহিংসতা
নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের বিবৃতিতে বলা হয়, গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ও বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটতে পারে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতেও প্রতিফলিত হচ্ছে। এর উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড।
হাইকমিশনের তথ্যমতে, গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন শরিফ ওসমান হাদি। উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
বিক্ষোভ ও ভারতবিরোধী অভিযোগ
হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিক্ষোভে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে—শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে নাকি অপরাধীদের সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। কিছু জায়গায় ভারতীয় দূতাবাস ও সহকারী হাইকমিশনের দিকে মিছিলের চেষ্টা হয়। পাশাপাশি কয়েকটি সংবাদমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলার ঘটনাও ঘটে, যাদের ‘ভারতপন্থী’ বলে অভিযোগ করা হয়।
ভারতের অবস্থান
ভারতের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না এবং শেখ হাসিনাকে কোনো রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দেওয়া হয়নি। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, ভারত বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ অন্তর্বর্তী সরকারের একাধিক প্রতিনিধি ভারতের নীরবতা এবং শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের এই উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। ১৯৭১ সালের পর থেকে ভারত বাংলাদেশকে তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত প্রতিবেশী হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। বর্তমান পরিস্থিতিকে ভারত তাদের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক ও নিরাপত্তাগত চ্যালেঞ্জ হিসেবেও দেখছে।
তবে উভয় দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সচেতন যে, পরিস্থিতি এখনো অস্থির এবং একে একমাত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্লেষণ না করে সংযত ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন জরুরি।
এই প্রেক্ষাপটে কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে নিয়মিত ও কার্যকর কূটনৈতিক যোগাযোগ বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে উভয় দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও সাম্প্রতিক বক্তব্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক রূপান্তর রক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।






