খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য সংকট: বিএনপি’র কর্মসূচি স্থগিত, নির্বাচন প্রভাবিত হতে পারে

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা: রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে নির্বাচনী সমীকরণে বড় পরিবর্তন।

বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া (৮০) বর্তমানে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সংকটাপন্ন সময় পার করছেন। ২৪ নভেম্বর রোববার মধ্যে রাতে হঠাৎ বুকের সংক্রমণ বেড়ে গেলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

দীর্ঘদিনের হৃদরোগ, লিভার সিরোসিস, কিডনি জটিলতা, ডায়াবেটিস ও আর্থ্রাইটিসের সাথে নতুন সংক্রমণ মিলিয়ে তাঁর অবস্থা গত কয়েকদিন ধরে “অত্যন্ত গুরুতর” বলে জানিয়েছে মেডিকেল বোর্ড।

স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা স্থিতিশীল, তবে গুরুতর

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, খালেদা জিয়া চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন এবং কয়েকটি শব্দ বলতে পারছেন। কোনো নতুন অবনতি হয়নি—এটিকে ‘সামান্য ইতিবাচক’ উন্নতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত একটি মেডিকেল টিম তাঁর চব্বিশ ঘণ্টা চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করছে। তরল খাবার তিনি গ্রহণ করছেন বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ভাষায়: “তিনি ফিরে আসার জন্য লড়াই করছেন।”

বিএনপির কর্মসূচি স্থগিত – দেশজুড়ে প্রার্থনা

বিএনপির সিনিয়র নেতারা জানিয়েছেন, চেয়ারপারসনের গুরুতর অসুস্থতার কারণে ডিসেম্বরের সব রাজনৈতিক কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। স্থগিত হওয়া কর্মসূচির মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ১-১৬ ডিসেম্বরের বিজয় মশাল রোড শো। দলীয় নেতারা দেশব্যাপী দোয়া ও প্রার্থনার আয়োজন করছেন। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলিম সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

জামায়াতে ইসলামী থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন পর্যন্ত তাঁর সুস্থতা কামনায় বিবৃতি দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজারো মানুষ দোয়া ও সহমর্মিতা জানিয়ে পোস্ট করছেন।

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে সরকারের নিশ্চয়তা

চেয়ারপারসনের একমাত্র জীবিত ছেলে এবং বিএনপির অ্যাকটিং চেয়ারম্যান তারেক রহমান এখনও লন্ডনে অবস্থান করছেন। মায়ের সংকটজনক অবস্থায় তিনি ফিরবেন কিনা—এটি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তারেক রহমান যদি দেশে ফেরার ইচ্ছা জানান, সরকারের পক্ষ থেকে এক দিনের মধ্যেই ওয়ান-টাইম ট্রাভেল পাস প্রদান করা হবে। কোনো বাধা নেই।”

বিএনপি নেতারা বলছেন, তিনি চিকিৎসকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং মাকে বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে পরামর্শ করছেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো তাঁর সিদ্ধান্তকে জটিল করে তুলেছে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে বড় পরিবর্তনের আভাস

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় বিএনপি বর্তমানে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী।

কিন্তু চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যসংকট দলটির নেতৃত্ব ও নির্বাচনী কৌশলে বড় ধাক্কা দিয়েছে। খালেদা জিয়া তিনটি আসনে লড়াই করার পরিকল্পনা করলেও এখন তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তারেক রহমানের অনুপস্থিতিও ভোট ব্যাংকে প্রভাব ফেলতে পারে।

এদিকে বাড়ছে নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান—জামায়াত, ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি), ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম—যা নির্বাচনী সমীকরণ বদলে দিচ্ছে।

অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতার ওপর সম্ভাব্য প্রভাব

খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে পারে।

নির্বাচন ঘিরে অস্থিরতা বাড়লে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২-৩% পর্যন্ত ধীর হতে পারে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা বাড়লে সামরিক হস্তক্ষেপের ঝুঁকিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নির্বাচনকে ঘিরে নতুন উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানসহ কয়েকটি দেশ খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় বিবৃতি দিয়েছে। ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার ওপর জোর দিচ্ছে।

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যসংকট শুধু বিএনপি নয়—বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের একজনের পাশে পুরো জাতি আজ উদ্বিগ্নভাবে দোয়া করছে।

আসন্ন কয়েকদিনই নির্ধারণ করবে—তাঁর শারীরিক অবস্থা এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রযাত্রা কোন দিকে যাবে।