বান্দরবানে জুম খাজনা আদায় সভা

৩৫৪ নং কেঙ্গু মৌজায় নতুন অর্থবছরের জুম খাজনা আদায় শুরু।
বান্দরবান থেকে অসীম রায় (অশ্বিনী): বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার ৩৫৪ নং কেঙ্গু মৌজায় বোমাং সার্কেল রাজার নির্দেশনায় ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুম খাজনা আদায় উপলক্ষে দিনব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
হেডম্যান কার্যালয়ে আয়োজিত এই সভায় ১৩টি পাড়ার কারবারি, মুরুব্বি ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। নতুন অর্থবছরের খাজনা আদায় কার্যক্রমকে আরও সুশৃঙ্খল, স্বচ্ছ এবং কার্যকর করার বিষয়টি ছিল সভার মূল লক্ষ্য।
কার্যালয়ের সামনে ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি সাজে সাজানো প্রাঙ্গণ এবং সভাকক্ষের আনুষ্ঠানিক পরিবেশ সভাকে প্রাণবন্ত করে তোলে।
সকাল ১০টায় শুরু হয়ে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলা এই সভায় সভাপতিত্ব করেন হেডম্যান ক্যসাউ মারমা। তিনি বোমাং সার্কেল রাজার প্রতিনিধি হিসেবে পুরো আলোচনাসভা পরিচালনা করেন।
সভায় জুম খাজনা তালিকার হালনাগাদ, আদায় পদ্ধতির স্বচ্ছতা, সময়মতো খাজনা সংগ্রহ এবং মাঠপর্যায়ের সমস্যা সমাধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কারবারিদের হাতে নতুন অর্থবছরের দাপ্তরিক কাগজপত্র তুলে দেওয়া হয় এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খাজনা আদায়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এছাড়া মাঠপর্যায়ের সমস্যা চিহ্নিত করতে এবং দ্রুত সমাধানের জন্য একটি সমন্বয়কারী কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
হেডম্যান ক্যসাউ মারমা বলেন, “বোমাং সার্কেল রাজার ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রতি বছর নিয়মিতভাবে জুম খাজনা আদায় করা হয়। এতে আমাদের সামাজিক-প্রশাসনিক কাঠামো সুসংহত থাকে। কারবারিদের সক্রিয় ভূমিকার মাধ্যমেই পাড়ায় পাড়ায় খাজনা আদায় দ্রুত সম্পন্ন হবে।”
পাড়াভিত্তিক প্রতিনিধি কারবারিরা তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে জানান, মাঠপর্যায়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হলেও যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে এসব সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব।
৫ নং পাড়ার কারবারি জনাক্ত চৌধুরী বলেন, “এবার অংশগ্রহণ বেশি হওয়ায় খাজনা আদায় আরও সহজ ও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হবে।”
৮ নং পাড়ার প্রকাশ মারমা মাঠপর্যায়ের বাস্তব সমস্যার প্রেক্ষিতে সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন।
জুম খাজনা ব্যবস্থা
জুম খাজনা পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রাচীন ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, যেখানে পাহাড়ি ঘূর্ণনভিত্তিক কৃষিজমি থেকে রাজস্ব নেওয়া হয়।
এর উৎপত্তি বহু পুরনো—আরাকান শাসনামল থেকে শুরু করে চাকমা রাজ্য, তারপর মাঙ্গ রাজবংশ এবং পরে ব্রিটিশ শাসন পর্যন্ত এই ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ ঘটে।
ঐতিহাসিক সময়রেখা — জুম খাজনার বিবর্তন
১৫শ শতাব্দী আরাকান রাজ্যের প্রভাব পাহাড়ি জমির প্রথম রাজস্ব ব্যবস্থা।
১৬শ শতাব্দী চাকমা রাজ্যের গঠন জুম খাজনার আনুষ্ঠানিক রূপ।
১৭শ শতাব্দী মাঙ্গ রাজবংশ সার্কেল রাজ্য ব্যবস্থা প্রবর্তন
১৭৬০ ব্রিটিশ দখল জুম ব্যবস্থার সরকারি স্বীকৃতি।
চাকমা রাজা বুদ্ধমঙ্গের আমলে (১৭শ শতাব্দী) এই ব্যবস্থায় সুস্পষ্ট কাঠামো আসে এবং পরবর্তীতে ৩৮টি সার্কেল গঠন করা হয়। হেডম্যান ও কারবারিদের মাধ্যমে এই রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া এখনো অব্যাহত রয়েছে। এসব রাজস্ব দিয়ে স্থানীয় উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা ও সামাজিক কল্যাণমূলক কাজে ব্যয় করা হয়।
এ বছর অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩০% বেশি ছিল। প্রথমবারের মতো ডিজিটাল খাজনা তালিকা তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়, যা পুরো প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত, স্বচ্ছ ও আধুনিক করবে। হেডম্যান জানান, ১০০% খাজনা আদায় এ বছরের লক্ষ্য।
স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বাসিন্দারা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানান। ৩ নং পাড়ার রিমা মারমা বলেন, “এ ধরনের সভা আমাদের সম্প্রদায়ের ঐক্য আরও বাড়ায়।”
৭ নং পাড়ার বাসিন্দা সুপ্রিম সাংমা মনে করেন, সময়মতো খাজনা দিলে উন্নয়ন প্রকল্পে এর সুফল পাওয়া যায়।
দিনব্যাপী এই সভা সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে কেঙ্গু মৌজার প্রশাসনিক কাঠামো আরও শক্তিশালী হলো।
ঐতিহ্যবাহী জুম খাজনা ব্যবস্থাকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করার উদ্যোগ পাহাড়ি সম্প্রদায়ের জন্য নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। স্থানীয়দের সহযোগিতা এবং কারবারিদের নেতৃত্বে এবছর জুম খাজনা আদায়ে নতুন রেকর্ড হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।






