অস্ত্র নয়, ভালোবাসার অস্ত্রে বম হৃদয় জয় করছে সেনাবাহিনী

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী: বম জাতির সঙ্গে বান্দরবান সেনা রিজিয়নের সহযোগিতা, শান্তি, উন্নয়ন ও সহায়তার অবিচ্ছিন্ন যাত্রা।
বান্দরবান প্রতিনিধি: পাহাড়ের বুকে যখন বন্দুকের শব্দে কেঁপে উঠতো বম পাড়া, যখন কেএনএফ-এর ভয়ে মায়েরা সন্তানদের জড়িয়ে রাত কাটাতেন, ঠিক তখনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এগিয়ে এসেছে অস্ত্র হাতে নয়, ভালোবাসা আর বিশ্বাসের হাত বাড়িয়ে।
গত এক বছরে বান্দরবান সেনা রিজিয়ন বম জনগোষ্ঠীর জন্য যা করেছে, তা কেবল সহায়তা নয়, একটি জাতির হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়ার মানবিক অধ্যায়।
যেখানে ৪০ বছর ধরে কোনো স্কুল ছিল না, সেখানে চুয়ানবিল পাড়ায় উঠেছে বম শিশুদের জন্য প্রি-প্রাইমারি স্কুল। সেনারাই বানিয়েছে ছাদ, দেয়াল আর স্বপ্ন। আজ সেই স্কুলে বম শিশুরা বাংলা-ইংরেজি আ-আ-ক-খ পড়ছে, হাসছে, গান গাইছে।
যেখানে কেএনএফ-এর ভয়ে বম পরিবারগুলো পালিয়ে গিয়েছিল মিয়ানমার সীমান্তে, সেখান থেকে শতাধিক পরিবারকে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়েছে সেনাবাহিনী। বাকলাই পাড়া, রেমাক্রী, রেং ত্লাং, এই সব দুর্গম এলাকায় সেনারা পৌঁছে দিয়েছে নিরাপত্তা আর আস্থা।
সুরক্ষা ও ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ: ভয়মুক্ত পরিবেশ গড়ে তোলা
গত বছরের শুরু থেকে কেএনএফ-এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বম জাতির শত শত পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় বান্দরবান সেনা রিজিয়ন বিশেষ অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি ধ্বংস করেছে এবং বম সম্প্রদায়কে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে আনার কাজ করেছে।
জানুয়ারি ২০২৫-এ রুমা ও থানচি উপজেলার সীমান্তবর্তী রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের বাকলাই বম পাড়ায় সেনা সহায়তায় ১০টি পরিবারের ২৬ জন সদস্য দীর্ঘ ১০ মাস পর নিজ বাড়িতে ফিরে আসেন।
ফেব্রুয়ারি মাসে থানচি উপজেলার বাকলাই পাড়ায় আরও ১৫টি পরিবারের ৮১ জন সদস্যকে সুরক্ষিত করে বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করা হয়।
জুলাই-আগস্ট ২০২৫-এ রুমা উপজেলার দুর্গম রেং ত্লাং এলাকায় এক মাসব্যাপী সামরিক অভিযান চালিয়ে কেএনএফ-এর প্রশিক্ষণ ঘাঁটি ধ্বংস করে। এতে বম সম্প্রদায়ের মধ্যে নিরাপত্তার আশা জাগে এবং স্থানীয়রা সেনার সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ায়।
বান্দরবান হিল ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের শান্তি প্রতিষ্ঠান কমিটির সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে সেনাবাহিনী বম নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে শান্তি প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়েছে।
আজ মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর), বম জাতির ইভানজেলিক্যাল খ্রিষ্টান চার্চে ১৬০টি চেয়ার বিতরণ করতে গিয়ে মেজর পারভেজ রহমান যখন বললেন, “আমরা আপনাদের পাশে আছি, থাকবো”, তখন চার্চের বুড়ো-বুড়ির চোখে পানি চিকচিক করে উঠলো। চেয়ার নয়, তারা যেন বিশ্বাসের আসন পেলেন।
ইসিসি চার্চ: বম জাতির খ্রিস্টানত্বের কেন্দ্রস্থল
পার্বত্য চট্টগ্রামের সবুজ পাহাড়ের কোলে, যেখানে বম জাতির মানুষগুলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবৃক্ষ, বৃষ্টি, সূর্য ও পাথরকে পূজা করতেন, সেখানে আজ খ্রিস্টান ধর্মের আলো ছড়িয়ে দিয়েছে ইভানজেলিক্যাল খ্রিস্টান চার্চ (ইসিসি)। বম জাতির ইসিসি চার্চ শুধু একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি জাতির পরিচয়, সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের মিলনস্থল।
অস্ত্র হাতে নয়, শিক্ষার বই, স্কুলের ঘণ্টা, চেয়ারের সারি আর মানুষের হাত ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ বম হৃদয় জয় করে নিচ্ছে।
পাহাড় যখন কাঁদছিল, তখন তারা এসেছে মুছিয়ে দিতে চোখের জল।
চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে শান্তির পথ
কেএনএফ-এর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর সহযোগিতা বম জাতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনছে। গত বছরে ৪,০০০-এর বেশি বম পরিবার বাস্তুচ্যুত হলেও সেনার উদ্যোগে অনেকে ফিরে এসেছে।
ভবিষ্যতে এই সহযোগিতা আরও গভীর হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি সম্ভব। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করে যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।







