মধুপুর ফল্ট: বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকি

ভূমিকম্প ও আফটারশকগুলো বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণতার বাস্তব চিত্র স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
টুইট প্রতিবেদক: মধুপুর ফল্ট (Madhupur Fault) বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে অবস্থিত একটি গুরুত্বপূর্ণ টেকটনিক ফল্ট লাইন, যা দেশের ভূমিকম্প ঝুঁকির সাথে সরাসরি সংযুক্ত। এটি মধুপুর ট্র্যাক্টের (Madhupur Tract) সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত, যা বাংলাদেশের ভূ-আকৃতি এবং নদী ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে।
ফল্টটি ঢাকা শহর থেকে নরসিংদী জেলার মধবদী উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত এবং জামালপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত প্রসারিত, ফলে ঢাকার অধিকাংশ অংশও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
মধুপুর ট্র্যাক্টের মোট আয়তন প্রায় ৪,২৪৪ বর্গকিলোমিটার, যা সাতটি ছোট আউটলিয়ার দিয়ে বিভক্ত। অঞ্চলটি সাধারণ ফ্লাডপ্লেইনের তুলনায় ১-১০ মিটার উঁচু, যা ফল্ট-সম্পর্কিত উত্তোলনের ফল। মাটি লালচে-বাদামী কাদামাটি (Madhupur clay) দিয়ে গঠিত, এতে ফেরুজিনাস নোডিউলস, ম্যাঙ্গানিজ স্পটস এবং পাইপস্টেম বিদ্যমান।
দক্ষিণাংশে সেডিমেন্টের পুরুত্ব ৩ থেকে ২০ কিমি, যা বেঙ্গল বেসিনের বৃহৎ সেডিমেন্ট ইনফ্লাক্স নির্দেশ করে। ফল্টের লম্ববৃত্তাকার লাইনগুলো উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিম দিকে সমান্তরাল, যা মধুপুর ট্র্যাক্টকে অসংখ্য উপত্যকায় বিভক্ত করেছে।
ভূতাত্ত্বিকভাবে, মধুপুর ফল্ট প্লাইস্টোসিন যুগের কোয়াটার্নারি ডিপোজিট থেকে গঠিত, যদিও এর উৎস সম্ভবত লেট মায়োসিন যুগে (২.৩ মিলিয়ন বছর আগে) বেঙ্গল বেসিনের দ্রুত পূরণের সময়। এটি একটি “blinding fault”, অর্থাৎ ভূমিস্তরের নিচে লুকিয়ে থাকা কিন্তু পৃষ্ঠে ফল্ট লাইন হিসেবে প্রকাশিত। মধুপুর ট্র্যাক্ট উত্তোলিত হর্স্ট ব্লক আকারে, যা বারিন্ড ট্র্যাক্টের সমান্তরাল ফল্ট সিস্টেম দ্বারা বিভক্ত।
মধুপুর ফল্ট ভারতীয়, বার্মিজ ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষের কারণে সক্রিয়। এটি রিভার্স ফল্টিং এবং নিওটেকটনিক কার্যক্রমের মাধ্যমে বারবার উত্তোলিত হয়েছে। ফল্টটি Western Deformation Front নামে পরিচিত একটি cryptic fault zone, যা যমুনা নদীর পূর্বে সারফেসে উঠে আসে। অঞ্চলটির টেকটনিক অস্থিরতা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সিসমিকিটি রেট নির্দেশ করে; ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল ভূমিকম্প সম্ভবত এই ফল্টের রাপচারের ফলে ঘটেছিল এবং সাম্প্রতিক ২০২৫ সালের ঢাকা ভূমিকম্পও এর সাথে সম্পর্কিত।
পরিবেশগত প্রভাবও গভীর। মধুপুর ট্র্যাক্টে থাকা মধুপুর ন্যাশনাল পার্ক ও ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্ক জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্র। এখানে লেপার্ড-ক্যাট, ফিশিং-ক্যাটসহ বিভিন্ন প্রজাতি রয়েছে। নদী ব্যবস্থা যেমন ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা ফল্টের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত। ঢাকার দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্প ও কৃষি সম্প্রসারণ এই অঞ্চলে টেকটনিক ঝুঁকি বাড়িয়েছে।
ভূমিকম্প ঝুঁকির ক্ষেত্রে, মধুপুর ফল্ট বাংলাদেশকে উচ্চ ঝুঁকিতে রাখে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান অনুযায়ী, যদি ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প সংঘটিত হয়, তাহলে ঢাকাসহ কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ১,৩০,০০০ জনের মৃত্যু এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।
ভবন নির্মাণের মানদণ্ড, জরুরি প্রস্তুতি এবং পরিবেশ সংরক্ষণ এই ফল্টের প্রতি দেশের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এবং আশেপাশের জেলায় ২১ নভেম্বর ২০২৫-এ সংঘটিত ৫.৫ মাত্রার মূল ভূমিকম্প দেশের মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। এ ভূমিকম্পে অন্তত ১০ জন নিহত এবং প্রায় ৩৫০–৬০০ জন আহত হয়েছে। ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল নরসিংদী জেলার মধবদী উপজেলা, ঢাকা থেকে ২৭ কিমি উত্তরে। ভূমিকম্পের গভীরতা মাত্র ১০ কিমি হওয়ায় ঢাকার পুরনো শহরে এবং আশপাশের আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়ে। গার্মেন্টস কারখানা ও কিছু ভবনে ফাটল দেখা গেছে এবং এক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
আফটারশক পরিস্থিতি
২২ নভেম্বর দুটি আফটারশক অনুভূত হয়েছে। প্রথমটি সকাল ১০:৩৬ মিনিটে ৩.৩ মাত্রার এবং কেন্দ্র ছিল আশুলিয়া, ঢাকার উত্তরে। এতে কোনো ক্ষতি বা হতাহত হয়নি। দ্বিতীয়টি বিকেল ৬:০৬ মিনিটে ৪.৩ মাত্রার, কেন্দ্র ঢাকার উত্তর-পূর্বে ৩২ কিমি দূরে, এবং ঢাকার মতুয়াইল, কাফরুল, ভাটারা, বসুন্ধরা ও উত্তরা এলাকায় ‘রোলিং’ ও ‘র্যাটলিং’ কম্পন অনুভূত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আফটারশকগুলো মূল ভূমিকম্পের স্বাভাবিক পরবর্তী ঘটনা এবং আরও ছোট-মাঝারি আফটারশক হতে পারে।
মধুপুর ফল্ট বাংলাদেশের ভূ-ঝুঁকিপূর্ণতার একটি প্রতীক এবং এটি ভবিষ্যতে স্থায়ী নগর পরিকল্পনা, দুর্যোগ প্রস্তুতি এবং জরুরি ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে।






