জুলাই গণআন্দোলনের দ্বিতীয় চার্জে শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আইসিটি-১-এর ঐতিহাসিক রায়। মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী, দুই চার্জে মৃত্যুদণ্ড।
- শেখ হাসিনা — ৫টি চার্জের মধ্যে ২টিতে মৃত্যুদণ্ড, ১টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল — ১টি চার্জে মৃত্যুদণ্ড।
- সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন — রাজসাক্ষী, সাজা ৫ বছর।
- রায়ের পরিশিষ্টে হাসিনার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে ভুক্তভোগী পরিবারকে দেওয়ার সুপারিশ।
টুইট প্রতিবেদক: বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ (আইসিটি-১) আজ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও আলোচিত রায় ঘোষণা করেছে। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে দায়ের করা মামলায় এই রায় দেওয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার আগের ও পরে কয়েকদিনে দেশজুড়ে সহিংসতা, ১৪ জন নিহত, বিভিন্ন স্থানে গ্রামীণ ব্যাংকের শাখা ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগ।
ট্রাইব্যুনাল পাঁচটি চার্জের সবগুলোতেই আসামিদের দোষী সাব্যস্ত করেছে।
চার্জ–১: গণহত্যা, গুলি, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড
স্থাপিত প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত বলেছে—হত্যা ছিল পরিকল্পিত
রায়: মৃত্যুদণ্ড (হাসিনা), অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য অভিযুক্তদেরও দোষী সাব্যস্ত
চার্জ–২: নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর নিষ্ঠুর হামলা (১৬–১৮ জুলাই, রামনা–শাহবাগ)
পুলিশের ওপর গুলি চালাতে বলা হয়েছিল
ড্রোন ও লেথাল অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ আদালত গ্রহণ করেছে
রায়: শেখ হাসিনা ও কামালের মৃত্যুদণ্ড
চার্জ–৩: হেলিকপ্টার ও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে অভিযানে নির্দেশদান
দক্ষিণ ঢাকার মেয়রের সঙ্গে ফোনালাপে নির্দেশের উল্লেখ
রায়: শেখ হাসিনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
চার্জ–৪: নির্যাতন, অবৈধ আটক, বাধ্যতামূলক গুম
আদালত বলেছে—রাষ্ট্রের শক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে অপব্যবহার করা হয়েছে
চার্জ–৫: লুকোচুরি, প্রমাণ নষ্ট, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পরিবর্তন
আবু সায়েদের রিপোর্ট ৪-৫ বার পরিবর্তনের দায় হাসিনার ওপর বর্তায়
সব মিলিয়ে রায় ছয়টি অংশে বিভক্ত ও সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।
সকাল ১১টায় রায় পাঠ শুরু হয় এবং লাইভ টেলিকাস্টের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের লাখো মানুষ তা প্রত্যক্ষ করে। ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ে পাঁচটি চার্জের মধ্যে শেখ হাসিনাকে দুইটিতে মৃত্যুদণ্ড এবং একটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কামালকে একটি চার্জে মৃত্যুদণ্ড এবং মামুনকে রাজসাক্ষী হিসেবে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এই মামলা ২০২৪ সালের জুলাই–অগাস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে গঠিত। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু হয়ে আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে—প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ, র্যাব এবং আওয়ামী লীগের সশস্ত্র কর্মীরা নিরস্ত্র ছাত্র ও সাধারণ নাগরিকদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। এই ঘটনায় এক হাজার চার শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছে বলে আদালত রায়ে উল্লেখ করে।
আদালত বলেছে, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকতে হেলিকপ্টার, ড্রোন, মারাত্মক অস্ত্র এবং অবরোধ ব্যবহার করে প্রতিবাদকারীদের দমন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
রায়ে উল্লেখ করা হয়—ছাত্র নেতা আবু সায়েদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট চার থেকে পাঁচবার পরিবর্তন করা হয়েছে। দক্ষিণ ঢাকা সিটির একজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনালাপের উদ্ধৃতি দিয়ে আদালত জানায়, শেখ হাসিনা নিজেই হেলিকপ্টার ও ভারী অস্ত্র ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আইসিটি মূলত ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য গঠিত হলেও পরবর্তীতে সংশোধনীর মাধ্যমে এটি সম্প্রসারণ করা হয়, যাতে হাসিনা সরকারের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধও বিচারাধীন হয়। প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনাকে “মাস্টারমাইন্ড এবং প্রিন্সিপাল আর্কিটেক্ট” বলে অভিহিত করে তাঁর মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন।
ট্রাইব্যুনালের এই মামলার চার্জশিট ছিল ১৩৫ পৃষ্ঠার এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের পরিমাণ ছিল ৮,৭৪৭ পৃষ্ঠা। মোট ৫৪ জন সাক্ষী আদালতে স্বাক্ষ্য দেন। আদালত রায়ে উল্লেখ করে যে প্রমাণ এতটাই শক্তিশালী যে বিশ্বের যেকোনো আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালও সর্বোচ্চ শাস্তি দিত। রায়টি ছয়টি অংশে বিভক্ত করে পাঠ করা হয় এবং পুরো প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশ টেলিভিশন, আইসিটির ফেসবুক পেজসহ বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
রায়ের পর দেশে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ, আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। গত কয়েকদিনে অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। গ্রামীণ ব্যাংকের কয়েকটি শাখা, সরকারী স্থাপনা, ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যা নাগাদ পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি সেনা মোতায়েন করা হয় যাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
রায়ের পরিশিষ্টে আদালত সুপারিশ করেছে, শেখ হাসিনার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে বিতরণ করা হোক। আদালত রাষ্ট্রকে নির্দেশ দিয়েছে, ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে এবং নতুন করে তদন্ত করে বাকি জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে।
এই রায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব অধ্যায় উন্মোচন করেছে। দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনের পর ক্ষমতাচ্যুত হয়ে অনুপস্থিতিতে দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া এ দেশের ইতিহাসে প্রথম।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা এবং সামাজিক পরিস্থিতির ওপর এই রায় দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে—এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।






