রাজশাহীতে বেশির ভাগ সিসি ক্যামেরা অকেজো, বেড়েছে অপরাধ
নিজস্ব প্রতিবেদক : বহুমুখী অপরাধ দমনে ও অপরাধী শনাক্তে ২০২১ সালে রাজশাহী মহানগরজুড়ে বিছানো হয়েছিল সিসি ক্যামেরার জাল। মহানগরীর প্রবেশদ্বারগুলোতেও স্থাপন করা হয়েছিল শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা। এসব সিসি ক্যামেরা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাজশাহী মহানগর পুলিশ স্থাপন করেছিল সাইবার কমান্ড কন্ট্রোল সেন্টার।
সিসি ক্যামেরা স্থাপন পরবর্তী সময়ে রাজশাহী মহানগর পুলিশ চাঞ্চল্যকর বেশ কয়েকটি ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যা মামলার রহস্য দ্রুত সময়ে উদঘাটন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। নগরবাসীর কাছে পুলিশের তখনকার এসব কর্মতৎপরতা ব্যাপক প্রশংসা পায়।
জানা যায়, আরএমপির সাবেক কমিশনার ডিআইজি আবু কালাম সিদ্দিকের উদ্যোগে রাজশাহী মহানগরীর সব সড়ক ও কোণে কোণে সাড়ে চার শতাধিক সিসি ক্যামেলার জাল বিছানো হয়েছিল। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অনুদান নিয়েই তিনি এসব ক্যামেরা স্থাপন করেছিলেন।
কিন্তু চলমান রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এসব ক্যামেরার অধিকাংশই এখন প্রায় অকেজো। অনেক জায়গায় কাটা পড়েছে তার। বৃষ্টির পানিতে ক্যামেরাগুলোর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়েছে। এসব ক্যামেরা আর মেরামত করেনি মহানগর পুলিশ। সিসি ক্যামেরাগুলো ঠিকমতো কাজ না করায় রাজশাহীতে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ডসহ অনেক অপরাধ এখন অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে। দিনের পর দিন সংঘটিত অনেক অপরাধের কিনারা করতে পারছে না পুলিশ।
ভুক্তভোগী নগরবাসীর অনেকের অভিযোগ, নিরাপত্তায় নিয়োজিত সিসি ক্যামেরাগুলো রক্ষণাবেক্ষণে যেমন অবহেলা আছে পুলিশের তেমনি অপরাধ দমনে আরএমপির বিভিন্ন থানা পুলিশের মনোযোগেও ভাটা পড়েছে। কেন এমনটা ঘটছে তাও অনেকের কাছে রহস্যাবৃত।
তবে অভিজ্ঞ মহলের অনেকেই মনে করেন সাবেক কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বদলি হয়ে যাওয়ার পর আরএমপির থানাগুলোতে ওসিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ণ পদে একাধিকবার ঘনঘন রদবদলের কারণে পুলিশের মনোবলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ফলে অপরাধ দমনেও পুলিশের মনোযোগে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।
এদিকে ভুক্তভোগী নগরবাসীর অনেকের অভিযোগ, রাজশাহী মহানগর পুলিশের অধীন থানাগুলোতে আগের সেই উদ্যেম আর উদ্যোগও যেন কমে এসেছে। ফলে হাল আমলে রাজশাহী মহানগরীতে বেড়েছে চুরি ছিনতাই ও খুনের মতো বড় সব অপরাধ। পুলিশ এসব অপরাধে জড়িতদের ধরতে কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না।
বিশেষ করে নগরীতে হাল আমলে ছিনতাই বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। রাতের নগরে সড়কে বের হলে অনেকেই ছিনতাই আতঙ্কে ভুগছেন। আর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েছে ভয়াবহ মাত্রায়। ফলে ক্রমেই শান্তির নগরীখ্যাত রাজশাহীর মানুষের মাঝে আতঙ্ক আর ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে।
এদিকে রোববার রাতে চার ঘণ্টার ব্যবধানে নগরীতে দুজন চিকিৎসক খুনের ঘটনার তিনদিন পার হলেও কোনো কূলকিনারা করতে পারেনি পুলিশ। রোববার দিনগত রাতে নগরীর চন্দ্রিমা থানার কৃষ্টগঞ্জ বাজার থেকে তুলে নিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় পল্লীচিকিৎসক এরশাদ আলী দুলালকে। পুলিশ দুজনকে আটক করলেও হত্যার রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি।
অন্যদিকে চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কাজেম আলীকে রোববার দিনগত রাত পৌনে ১২টায় নগরীর প্রাণকেন্দ্র বর্ণালী মোড়ে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা ছুরিকাঘাতে খুন করে। এ ঘটনার দুদিন পরও পুলিশ হত্যার রহস্যের কিনারা করতে পারেনি।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার ডিআইজি বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, দুই চিকিৎসক খুনের দুটি ঘটনাকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তদন্ত করছি। আশা করছি, দ্রুত সময়েই দুই খুনের রহস্য উদঘাটন হবে ও অপরাধীরা গ্রেফতার হবে। মহানগর পুলিশের একাধিক টিম দুই খুনের ঘটনার রসহ্য উদঘাটনে কাজ করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাতের রাজশাহী নগরীতে ছিনতাই চক্রের দৌরাত্ম্য মারাত্মকভাবে বেড়েছে। যে রাতে দুই চিকিৎসক খুন হন সেই রাতেই রাজশাহী রেলস্টেশন এলাকায় সশস্ত্র ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন দুই কলেজছাত্র কৌশিক ও অভিজিৎ।
ছিনতাইকারীদের ধারাল অস্ত্রের আঘাতে তারা দুজনই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গত ১৭ সেপ্টেম্বর দিনের বেলায় নগরীর কাদিরগঞ্জ এলাকায় ছিনতাইকারীদের আঘাতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান রাজশাহী কলেজের পরিসংখ্যান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নিশাদ আকরাম রিংকু। ১৬ দিন মৃত্যুর সঙ্গে পঞ্জা লড়ে গত ৩ অক্টোবর তিনি মারা যান। রিংকুর বাড়ি নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার সেরাজপুর গ্রামে।
এদিকে গত ৪ অক্টোবর রাতে একদল মুখোশধারী সন্ত্রাসী মাইক্রোবাসে করে এসে কাটাখালী থানার হরিয়ান বাজারের ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ী শাহীন আলীর দোকানে ঢুকে তাকে অস্ত্রের মুখে অপহরণের চেষ্টা করে। একপর্যায়ে শাহীন আলীকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়।
এলাকাবাসী শাহীন আলীকে উদ্ধারে এগিয়ে এলে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়ে সন্ত্রাসীরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এ ঘটনার প্রায় এক মাস অতিক্রান্ত হলেও পুলিশ কাউকে শনাক্ত অথবা গ্রেফতার করতে পারেনি। গুরুতর জখম শাহীন আলী এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, রাজশাহী মহানগর এলাকার ভদ্রা মোড় থেকে তালাইমারী, বিমান সড়ক, বিলসিমলা, সিটিহাট সড়ক, গ্রেটার রোড, সিটি ও রাজশাহী বাইপাসসহ অন্তত ১১টি সড়ক সন্ধ্যা নামলেই কিশোর গ্যাংয়ের দখলে চলে যায়।
কিশোর গ্যাং মোটরসাইকেলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। পথচারী বা অটোযাত্রী দেখলেই মোবাইল ফোনসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, তারা তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশে অভিযোগ করলেও পুলিশ বেপরোয়া কিশোর গ্যাং ছিনতাইকারীদের ধরছে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী মহানগরী এলাকার বিভিন্ন সড়কে পুলিশের উদ্যোগে ৪৫০টি সিসি ক্যামেরা সক্রিয় ছিল। কিন্তু নানান কারিগরি ক্রটির কারণে এসব সিসি ক্যামেরার অনেকগুলো এখন সক্রিয় নেই।
আরএমপির একজন কর্মকর্তা জানান, তাদের সিসি ক্যামেরাগুলোর তার কেটে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে। আবার সিটি কর্পোরেশনের সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণকারী ঠিকাদাররাও সিসি ক্যামেরার তার কেটে দিচ্ছে। ফলে অনেক এলাকায় সিটি ক্যামেরা কাজ করছে না। এতে অপরাধীরা অপরাধ সংঘটনে উৎসাহী হচ্ছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, নগরীর সিসি ক্যামেরাগুলো পুরোপুরি সক্রিয় করতে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সন্দেহভাজন অপরাধীদের গতিবিধি শনাক্তে সিসি ক্যামেরা কার্যকর একটি হাতিয়ার পুলিশের। যেসব সিসি ক্যামেরা অকেজো অবস্থায় আছে সেগুলিকে শিগগির ঠিক করা হবে। সূত্র- যুগান্তর