কেন বারবার একই দাবি? পাহাড়ে ক্ষোভ

বিচারহীনতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে পাহাড়ে ক্ষোভ: বান্দরবানে মানববন্ধন, রাঙামাটিতে নৌপথে প্রতিবাদ।

ব‌দিউল আলম লিংকন: পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের ঘটনাগুলো বারবার স‌াম‌নে আস‌ছে বা সংঘটিত হচ্ছে। কিন্তু বিচার না হওয়ায় এবং স্থানীয় কারবারীদের প্রথাগত বিচারের নামে ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগে ক্ষোভ বাড়ছে।

এই পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ (পিসিসিপি) বান্দরবানে মানববন্ধন এবং রাঙামাটিতে নৌপথে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে। ধর্ষণের ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়া এবং রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের বিরুদ্ধেও তারা সোচ্চার র‌য়ে‌ছে।

বারবার একই দাবি: বিচারহীনতার প্রতিবাদ

সাম্প্রতিক সময়ে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে এক প্রতিবন্ধী মারমা নারীকে তিন মারমা যুবক কর্তৃক গণধর্ষণ, খাগড়াছড়ির মাটিরাঙায় এক ত্রিপুরা কিশোরীকে চার পাহাড়ি যুবকের ধর্ষণ এবং পানছড়ির আলুটিলা এলাকায় চাকমা সম্প্রদায়ের এক শিক্ষিকাকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে ধর্ষণের ঘটনায় স্থানীয় জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এসব ঘটনায় অভিযুক্তদের কেউ কেউ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও, আইনি বিচার প্রক্রিয়া এগোচ্ছে না বলে অভিযোগ।

বক্তারা বলছেন, স্থানীয় কারবারীরা প্রথাগত বিচারের নামে এসব ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন, যা ন্যায়বিচারের পথে বাধা।

বলা বাহুল‌্য, কাপ্তাইয়ের প্রতিবন্ধী মারমা নারী গণধর্ষণের শিকার হয়ে আন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, কিন্তু অভিযুক্তদের কোনো আইনি শাস্তি হয়নি। গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিয়ে কোনো স্পষ্ট সিদ্ধান্ত নেই, ব‌লে দাবী করা হ‌চ্ছে।

মাটিরাঙায় ত্রিপুরা কিশোরীর ঘটনায় চার অভিযুক্তের মধ্যে দুজন গ্রেফতার হয়েছে, তবে বিচার প্রক্রিয়া ধীরগ‌তি।

পানছড়ির শিক্ষিকার ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত লিটন ত্রিপুরা (২৪) গ্রেফতার হলেও, আইনি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

তবে এলাকাজুড়ে গুঞ্জন রয়েছে—কিছু ঘটনা নাকি অতিরঞ্জিত, এমনকি কাল্পনিকও। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, এসব ঘটনার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।

বান্দরবানে মানববন্ধন: ন্যায়বিচারের দাবি

আজ সোমবার (২৭ অক্টোবর) সকালে বান্দরবানের শহীদ আবু সাঈদ মুক্ত মঞ্চ চত্বরে পিসিসিপি বান্দরবান জেলা শাখার উদ্যোগে মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কারবারীদের ধামাচাপা দেওয়ার প্রতিবাদ এবং গণধর্ষণের ঘটনাগুলোর দ্রুত আইনি বিচারের দাবি জানানো হয়। সংগঠনের নেতারা বলেন, “এই ঘটনাগুলোকে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়া হচ্ছে, যা পাহাড়ের শান্তি ও সৌহার্দ্য নষ্ট করছে। আমরা চাই সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার।”

রাঙামাটিতে নৌপথে প্রতিবাদ: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সতর্কবাণী

শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদের শহীদ মিনার ঘাট থেকে শুভলং ঝর্ণা পর্যন্ত পিসিসিপি রাঙামাটি জেলা শাখা নৌযানে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মানববন্ধন করে।

শুভলং ঝর্ণার সামনে প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পিসিসিপি রাঙামাটি জেলা সভাপতি তাজুল ইসলাম তাজ এবং সঞ্চালনা করেন সাংগঠনিক সম্পাদক মো. পারভেজ মোশাররফ হোসেন। বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর হোসেন, পিসিএনপি রাঙামাটি জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক হুমায়ুন কবির, বরকল উপজেলা নেতা সোহরাব হোসেন, এমদাদুল ইসলাম, রিয়াজুল ইসলাম বাবু, আরিয়ান রিয়াজ প্রমুখ।

বক্তারা বলেন, “ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে জাতিগত বা সাম্প্রদায়িক ইস্যু বানিয়ে পাহাড়ের শান্তি নষ্ট করা হচ্ছে। অধিকারকর্মীদের নীরবতা এবং কারবারীদের ধামাচাপার প্রচেষ্টা ন্যায়বিচারের পথে বাধা। আমরা চাই সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।”

কেন বারবার এই ঘটনা?

পার্বত্য অঞ্চলে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে, কিন্তু বিচারহীনতা এবং স্থানীয় কারবারীদের প্রথাগত বিচারের নামে সমাধানের চেষ্টা এই সমস্যাকে আরও জটিল করছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করছেন, কারবারীরা প্রায়ই অভিযুক্তদের পক্ষ নিয়ে ঘটনা মীমাংসার চেষ্টা করেন, যা আইনি বিচারের পরিবর্তে ধামাচাপার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া, এসব ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়ায় জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে, যা পাহাড়ের সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি।

পুলিশ জানিয়েছে, মাটিরাঙার ঘটনায় চারজনের মধ্যে দুজন এবং পানছড়ির ঘটনায় অভিযুক্ত লিটন ত্রিপুরা গ্রেফতার হয়েছে। তবে তদন্ত এখনও চলছে, এবং কারবারীদের ভূমিকা নিয়ে তদন্তের দাবি উঠেছে।

জনগণের আকুতি: ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা

মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীরা বলছেন, পাহাড়ে নারী নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ করে সব ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

পিসিসিপির নেতারা সতর্ক করে বলেন, “এটি কোনো জাতিগত বা ধর্মীয় ইস্যু নয়, এটি মানবাধিকারের প্রশ্ন। বিচারহীনতা বন্ধ না হলে এই ঘটনা বাড়তেই থাকবে।”

পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্ষণের ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি এবং বিচারহীনতা স্থানীয় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। কারবারীদের ধামাচাপার প্রচেষ্টা এবং সাম্প্রদায়িক রঙ দেওয়ার প্রবণতা এই সংকটকে আরও জটিল করছে। পিসিসিপির মানববন্ধন এবং নৌপথে প্রতিবাদ এই সমস্যার প্রতি সরকার ও সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

দ্রুত আইনি বিচার এবং নারী নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না গেলে পাহাড়ের সামাজিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়তে পারে।