জুলাই জাতীয় সনদ ও গণভোট : জামায়াত, বিএনপি ও এনসিপির অবস্থান
জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।
বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রেফারেন্ডামের (গণভোট) বিষয়টি সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এই বিষয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি)-এর মধ্যে মতপার্থক্য এবং পরবর্তী ঐকমত্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
২২ অক্টোবর সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে জামায়াতের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় জামায়াতের নায়েবে আমির ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। এই প্রতিবেদনে রেফারেন্ডাম নিয়ে বিএনপির অবস্থান, জামায়াতের যুক্তি এবং এর রাজনৈতিক তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হলো।
বিএনপির প্রাথমিক অবস্থান
জামায়াতের নায়েবে আমির ড. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের জানান, রেফারেন্ডামের বিষয়ে প্রাথমিকভাবে বিএনপি অনাগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
তিনি বলেন, প্রথমে বিএনপি রেফারেন্ডামের বিষয়ে অনাগ্রহী ছিল। আমরা জোর দিয়ে বিষয়টি তুললে পরে তারা এতে রাজি হয়। এজন্য আমরা বিএনপিকে ধন্যবাদ জানাই।”
তবে, বিএনপি পরবর্তীতে রেফারেন্ডামের পক্ষে সম্মতি জানালেও তারা একটি নতুন শর্ত জুড়ে দিয়েছে। তারা প্রস্তাব করেছে যে, রেফারেন্ডাম এবং জাতীয় নির্বাচন একই দিনে অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এই প্রস্তাব জামায়াতের দৃষ্টিকোণ থেকে অযৌক্তিক এবং অপ্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত হয়েছে। তাহের এ বিষয়ে বলেন, “তারা এখন বলছে রেফারেন্ডাম ও জাতীয় নির্বাচন একই দিনে হতে হবে—যা একেবারেই ভিন্ন বিষয়।”
জামায়াতের যুক্তি
জামায়াতে ইসলামী রেফারেন্ডাম এবং জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য দেখছে। তাদের মতে, রেফারেন্ডাম হলো জনগণের মতামত গ্রহণের একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জুলাই জাতীয় সনদের বিষয়ে জনগণের সমর্থন বা বিরোধিতা যাচাই করা হবে। তাহের এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলেন,
“রেফারেন্ডাম মূলত রাষ্ট্র পরিচালনা, নির্বাচনী কাঠামো ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ইত্যাদি সংস্কারের প্রশ্নে জনগণের মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া। এটি জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে এক করার যৌক্তিকতা নেই।”
তিনি আরও যুক্তি দেন, “যদি জনগণ ‘হ্যাঁ’ বলে, তাহলে সনদ কার্যকর হবে; আর ‘না’ বললে হবে না। পরে সেই অনুযায়ী নির্বাচন হবে।”
জামায়াতের এই যুক্তির মূল ভিত্তি হলো, রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে জুলাই জাতীয় সনদের আইনি বৈধতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া, যা জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললে এর মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে পারে। তাহেরের মতে, রেফারেন্ডাম জনগণের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, এবং এটি জাতীয় নির্বাচনের আগে সম্পন্ন করা উচিত।
অতীতের দৃষ্টান্ত
জামায়াতের প্রতিনিধি দল রেফারেন্ডাম এবং নির্বাচনের মধ্যে সময়ের ব্যবধানের বিষয়ে অতীতের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে। তাহের জানান, বাংলাদেশে পূর্বে দুটি রেফারেন্ডাম অনুষ্ঠিত হয়েছিল—একটি ১৭ দিনের ব্যবধানে এবং আরেকটি ২১ দিনের ব্যবধানে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি প্রস্তাব করেন,
“নভেম্বরের শেষ দিকে রেফারেন্ডাম হলে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যাবে।”
এই সময়সূচি প্রস্তাবের মাধ্যমে জামায়াত স্পষ্ট করে যে, রেফারেন্ডাম এবং জাতীয় নির্বাচন আলাদাভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভব এবং এটি প্রক্রিয়াটিকে আরও সুশৃঙ্খল ও স্বচ্ছ করবে।
মতৈক্য ও মতপার্থক্য
জামায়াত নেতা তাহের জানান, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের বিষয়ে ৩১টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, এবং এর মধ্যে ২৯টি দল সর্বসম্মতভাবে এই সনদ এবং রেফারেন্ডামের পক্ষে মত দিয়েছে। তিনি বলেন,
“যদি ১-২টি দল আপত্তি জানায়, তা মূল সিদ্ধান্ত বাতিল করে না—বরং এটি একটি নোট অব ডিসেন্ট মাত্র। এর ভিত্তিতে নতুন রেফারেন্ডাম বা নতুন সিদ্ধান্তের দাবি অনর্থক জটিলতা সৃষ্টি করবে।”
বিএনপির রেফারেন্ডাম ও নির্বাচন একই দিনে আয়োজনের প্রস্তাবকে জামায়াত এই জটিলতার অংশ হিসেবে দেখছে। তাদের মতে, এই প্রস্তাব প্রক্রিয়াটিকে অপ্রয়োজনীয়ভাবে জটিল করে তুলতে পারে এবং জনগণের মতামত যাচাইয়ের মূল উদ্দেশ্যকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
এনসিপির অবস্থান
এনসিপি জুলাই সনদ এবং রেফারেন্ডাম নিয়ে ‘সংস্কারের পক্ষে, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে’ অবস্থান নিয়েছে। তাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত অটল থাকার ঘোষণা রাজনৈতিক পরিসরে নতুন আলোচনার সূচনা করেছে। দলটি জনগণের মধ্যে তাদের অবস্থান ছড়িয়ে দিতে ‘জুলাই পদযাত্রা’র মতো কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।
দলটির সভাপতি নাহিদ ইসলাম এবং অন্যান্য নেতারা বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের মতামত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া (রেফারেন্ডাম) অত্যন্ত জরুরি, কিন্তু সনদের বর্তমান খসড়ায় তাদের কয়েকটি মূল দাবি অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
ভবিষ্যতে এই অবস্থান কীভাবে পরিবর্তিত হয়, তা রাজনৈতিক ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে আরও আলোচনার উপর নির্ভর করবে।
রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটুকু?
রেফারেন্ডাম নিয়ে বিএনপি এবং জামায়াতের এই মতপার্থক্য বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জুলাই জাতীয় সনদ রাষ্ট্রীয় সংস্কার এবং নির্বাচনী কাঠামোর সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য রেফারেন্ডামের মাধ্যমে জনগণের সমর্থন অর্জন অত্যন্ত জরুরি। জামায়াতের যুক্তি অনুসারে, রেফারেন্ডামকে জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেললে জনগণের মতামত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হতে পারে এবং এটি সংস্কার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতার উপর প্রশ্ন তুলতে পারে।
অন্যদিকে, বিএনপির প্রস্তাবে সময় ও সম্পদ সাশ্রয়ের বিষয়টি থাকলেও, এটি জনগণের মতামত যাচাইয়ের স্বতন্ত্রতা এবং গুরুত্বকে কমিয়ে দিতে পারে। জামায়াতের প্রস্তাবিত সময়সূচি (নভেম্বরে রেফারেন্ডাম এবং ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে নির্বাচন) এই প্রক্রিয়াকে আরও সুশৃঙ্খল ও কার্যকর করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
রেফারেন্ডাম নিয়ে বিএনপির প্রাথমিক অনাগ্রহ এবং পরবর্তীতে একই দিনে নির্বাচন ও রেফারেন্ডাম আয়োজনের প্রস্তাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্যের চ্যালেঞ্জকে সামনে এনেছে। তবে জামায়াতে ইসলামীর যুক্তি এবং অতীতের দৃষ্টান্তের ভিত্তিতে রেফারেন্ডামকে একটি স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করার পক্ষে শক্তিশালী যুক্তি উপস্থাপিত হয়েছে।
এই বিতর্কের মধ্য দিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।