বাংলাদেশের আকাশে ‘তুর্কি স্টিল ডোম’ আসছে: হিসার ও সিপার সিস্টেমে দেশ

বাংলাদেশ-তুরস্ক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা: হিসার ও সিপার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ক্ষমতা অধ্যয়ন শুরু।

টুইট প্রতিবেদক: বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা ক্রমেই গভীরতর হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যে এর প্রভাব পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

সর্বশেষ, বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকরা তুরস্কের উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসার (Hisar) ও সিপার (Siper) সিস্টেমের প্রযুক্তিগত ক্ষমতা ও কার্যকারিতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে অধ্যয়ন শুরু করেছেন।

প্রেক্ষাপট ও সাম্প্রতিক অগ্রগতি

অক্টোবর মাসের শুরুতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান তুরস্ক সফর করেন। এই সফরে তিনি তুরস্কের শীর্ষ প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠান—Aselsan, Roketsan ও Turkish Aerospace Industries (TAI)—এর কর্মকর্তাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করেন।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশ এখন তুরস্কের হিসার-ও+ (Hisar-O+) মধ্যম-পাল্লার সিস্টেম এবং সিপার (Siper) দীর্ঘ-পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনায় রয়েছে। এটি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ‘Forces Goal 2030’ আধুনিকায়ন পরিকল্পনার অংশ।

বাংলাদেশি প্রতিরক্ষা প্রতিনিধিদল ইতিমধ্যেই তুরস্কের অ্যাকসারে (Aksaray) টেস্ট রেঞ্জে গিয়ে হিসার সিস্টেমের লাইভ ফায়ার টেস্ট পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের মূল লক্ষ্য হলো সিস্টেমগুলোর পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করা, বাংলাদেশের ভৌগোলিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জস্য যাচাই করা এবং সম্ভাব্য কাস্টমাইজেশন নির্ধারণ করা।

হিসার ও সিপার: প্রযুক্তিগত বৈশিষ্ট্য ও ক্ষমতা

তুরস্কের তৈরি ‘স্টিল ডোম (Steel Dome)’ নামে পরিচিত জাতীয় আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় অংশ হলো হিসার ও সিপার। হিসার-ও+ একটি মধ্যম-পাল্লার মোবাইল এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যার পাল্লা ২৫ থেকে ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এটি যুদ্ধবিমান, ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন এবং এয়ার-টু-গ্রাউন্ড মিসাইল লক্ষ্যবস্তু ধ্বংসে সক্ষম। সিস্টেমটি মার্সিডিজ-বেঞ্জ জেট্রোস ৬×৬ শ্যাসিসে স্থাপিত, ফলে এটি দ্রুত মোতায়েনযোগ্য ও চলনক্ষম।

অন্যদিকে, সিপার (Siper) ব্লক-১ হলো দীর্ঘ-পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যার কার্যকর পাল্লা ১০০ কিলোমিটার এবং উচ্চতা ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত। পরবর্তী ব্লক সংস্করণগুলোতে এটি ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিক মিসাইল প্রতিরোধেও সক্ষম হবে বলে জানিয়েছে Roketsan।

এই সিস্টেমগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে ALP-300G লং-রেঞ্জ এস-ব্যান্ড রাডার, যা ৮০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তু সনাক্ত করতে পারে। এতে রয়েছে ইলেকট্রনিক স্ক্যানিং, ডিজিটাল বিম ফর্মিং, টার্গেট ক্লাসিফিকেশন, NATO-সম্মত IFF সিস্টেম, সাইবার সিকিউরিটি এবং অ্যান্টি-রেডিয়েশন মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা। রাডারটি ৩০ মিনিটের মধ্যে মোতায়েনযোগ্য এবং এর কার্যকারিতা ৯৯.৯% পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য।

এই সিস্টেমগুলো বাংলাদেশে বিদ্যমান চীনা ও রুশ প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের সঙ্গে একীভূত করে একটি মাল্টি-লেয়ারড আকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক তৈরি করা সম্ভব হবে, যা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।

চুক্তির অগ্রগতি ও সম্ভাব্য ডেলিভারি

চলমান অধ্যয়নের পর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় একটি প্রাথমিক ক্রয়চুক্তি স্বাক্ষরের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম হিসার-ও+ ব্যাটারিগুলো ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ এবং সিপার সিস্টেমগুলো ২০২৭-২০২৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে পৌঁছাতে পারে।

তুর্কি কম্ব্যাট ড্রোন, যেমন Bayraktar TB2, বাংলাদেশের মাটিতে স্থানীয়ভাবে অ্যাসেম্বল বা উৎপাদনের বিষয়ে আলোচনাও চলছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই তুরস্কের TRG-300 রকেট সিস্টেম, Cobra-II সাঁজোয়া যান এবং Bayraktar TB2 ড্রোন ব্যবহার করছে, যা দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করেছে।

আঞ্চলিক কৌশলগত প্রভাব ও ভারতের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের এই পদক্ষেপকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা “একটি প্রজন্মগত অগ্রগতি (Generational Leap)” বলে উল্লেখ করেছেন। এটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা কৌশলে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে, যেখানে দেশটি চীন ও রাশিয়ার নির্ভরতা কমিয়ে তুরস্কের মতো NATO-সম্মত অংশীদারের দিকে ঝুঁকছে।

অন্যদিকে, ভারতীয় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা এই উদ্যোগকে “অনাকাঙ্ক্ষিত কৌশলগত মাথাব্যথা (Unwelcome Strategic Headache)” বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, সিপার সিস্টেমটি ভারতের রাশিয়ান উৎসের প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির (বিশেষত ব্রহ্মোস মিসাইল) বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে, যা আঞ্চলিক ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করবে।

তুর্কি সংবাদমাধ্যমগুলো এটিকে “ভারতকে কৌশলগতভাবে কোণঠাসা করার পদক্ষেপ” হিসেবে ব্যাখ্যা করছে। বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ বলেন, “এই পদক্ষেপ মূলত মিয়ানমারের সীমান্তে চলমান সংঘাত ও আঞ্চলিক নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের জন্য এটি আকাশ প্রতিরক্ষায় আত্মনির্ভরতার দিকে একটি দৃঢ় পদক্ষেপ।”

বাংলাদেশ-তুরস্ক প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এখন এক নতুন উচ্চতায়। হিসার ও সিপার সিস্টেম অধ্যয়ন বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। এই সিস্টেমগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আধুনিক ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে।

তবে আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়া, বিশেষ করে ভারতের উদ্বেগ এবং মিয়ানমার পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে, এই চুক্তির কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে।