অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা ট্রাইব্যুনালে: গুম-খুন মামলায় ঐতিহাসিক শুনানি শুরু

  • জাতিসংঘের আহ্বান—বেসামরিক আদালতে হস্তান্তর করুন।
  • সেনা জবাবদিহিতার নতুন অধ্যায় শুরু বাংলাদেশে

টুইট প্রতি‌বেদক: বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আজ সকাল সোয়া ৭টার দিকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হাজির করা হয় সেনাবাহিনীর ১৫ জন অভিযুক্ত কর্মকর্তা‌কে। এরা আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে (২০০৯–২০২৪) সংঘটিত গুম, খুন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার প্রধান আসামি।

এই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—তারা ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতা, সাংবাদিক, লেখক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের গুম, নির্যাতন ও হত্যায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে “অপারেশন মিডনাইট” নামে পরিচিত গোপন অভিযান, যার অধীনে ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শতাধিক নিখোঁজ ঘটনার সূত্র পাওয়া যায়।

অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই)-এর সাবেক প্রধান, সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা এবং সেনা সদর দপ্তরের কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার। মোট অভিযুক্ত ২৮ জনের মধ্যে ২৫ জন সেনা কর্মকর্তা, ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত, ১ জন এলপিআর-এ (লিভ প্রিপারেটরি টু রিটায়ারমেন্ট) এবং বাকি ১৫ জন কর্মরত অবস্থায় ছিলেন।

গ্রেপ্তার ও হেফাজতের ইতিহাস

চার্জশিট দাখিলের পর গত ৮ অক্টোবর সেনা সদর দপ্তর থেকে অভিযুক্ত ১৫ জনকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়। সেনাবাহিনী জানিয়েছিল, আদালতের আনুষ্ঠানিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা না পাওয়া সত্ত্বেও তারা ‘আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে’ অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের আটক করে রেখেছে।

একজন আসামি—মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ—এখনও পলাতক বলে জানা গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক রেড নোটিশ জারি করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

আদালতের শুনানি ও প্রসিকিউশনের বক্তব্য

আজকের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন,

“অভিযুক্ত ১৫ কর্মকর্তার মধ্যে ৪ জন এখনো সেনা বাহিনীতে কর্মরত। আইন অনুযায়ী, এদের চাকরিতে রাখা বেআইনি—বিচারাধীন অপরাধে তারা সক্রিয় পদে থাকতে পারেন না।”

তিনি আদালতের কাছে অনুরোধ জানান, আসামিদের সাময়িক বরখাস্ত করে তাদের সম্পূর্ণভাবে বেসামরিক আদালতের হেফাজতে নেওয়া হোক।

সহকারী প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন,

“এই মামলা কেবল ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, রাষ্ট্রীয় দমননীতির সাংগঠনিক দায়ও উন্মোচিত করবে।”

সেনাবাহিনীর অবস্থান

সেনা সদর দপ্তর জানায়, ট্রাইব্যুনালের আদেশ অনুযায়ী তারা পূর্ণ সহযোগিতা করছে। অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের “সেনা হেফাজতে” রাখা হয়েছে নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলার স্বার্থে। শুনানির দিনগুলোতে তাদের আদালতে হাজির করা হবে এবং শেষে পুনরায় সেনা হেফাজতে ফেরত নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর মুখপাত্র ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. রাশেদুল ইসলাম বলেন,

“সেনা বাহিনী আইন ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমরা কারো জন্য রক্ষা-কবচ নই।”

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় (OHCHR) এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে, অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের দ্রুত বেসামরিক ট্রাইব্যুনালের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে হস্তান্তর করতে এবং বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ রাখতে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে,

“এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক সুযোগ—গুম ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে দৃষ্টান্তমূলক বিচার প্রতিষ্ঠা করতে।”

জুলাই ২০২৫-এ সংঘটিত সেনা বিদ্রোহের পর থেকেই সামরিক জবাবদিহিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছিল। এই মামলাটি সে প্রেক্ষাপটে একটি বড় মোড়। দীর্ঘদিন ধরেই মানবাধিকার সংগঠনগুলো সেনা সদস্যদের দায়মুক্তি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছিল।

বিশ্লেষকদের মতে, এই শুনানি সফলভাবে শেষ হলে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার প্রতি আন্তর্জাতিক আস্থা ফিরে আসবে এবং সামরিক বাহিনীর কাঠামোতেও দায়বদ্ধতার নতুন অধ্যায় সূচিত হবে।

অভিযুক্ত ১৫ সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে চলমান এই বিচার শুধু ব্যক্তিগত অপরাধ নয়, বরং রাষ্ট্রীয় জবাবদিহিতার পরীক্ষাও।

আদালতের শুনানি চলমান রয়েছে, এবং রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত গোটা দেশ গভীর আগ্রহে পর্যবেক্ষণ করছে এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া।