মহেশখালী-মাতারবাড়ি: বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে নীল শক্তি
- বঙ্গোপসাগরের নীল অর্থনীতি: বাংলাদেশের রপ্তানি সম্ভাবনা বৃদ্ধি
- ডিপ-সি পোর্ট ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে মহেশখালীর রূপান্তর
- গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষে বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ তৈরি করছে MIDA
- নতুন অ্যাকশন প্ল্যান: সীফুড রপ্তানি ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি
- বঙ্গোপসাগরের নীল সম্পদ: MIDA-এর মাধ্যমে গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষে নতুন দিগন্ত।
টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশের নীল অর্থনীতি (Blue Economy) সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে মহেশখালী ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (MIDA) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের বিস্তীর্ণ এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (EEZ) ব্যবহার করে গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষ ও প্রসেসিং শিল্পকে একটি আন্তর্জাতিক মানের শিল্পে রূপান্তর করার লক্ষ্যে MIDA সাম্প্রতিক উচ্চপর্যায়ের আলোচনা সভা আয়োজন করেছে।
MIDA উদ্যোগ: গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষকে কেন্দ্রবিন্দুতে
গত ১৩ অক্টোবর ঢাকার বিডিআইএ ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটি (বিইজেডএ), এনবিআর এবং কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তারা অংশ নেন। MIDA-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীর সভাপতিত্বে গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষকে MIDA-এর চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
সভায় আট-দফা অ্যাকশন প্ল্যান গ্রহণ করা হয়, যা গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষ, লজিস্টিক সুবিধা, বিনিয়োগ-বান্ধব পরিবেশ এবং রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে।
মূল সিদ্ধান্তসমূহ:
বন্ডেড সুবিধা: সম্পূর্ণ রপ্তানিমুখী সীফুড প্রসেসরদের জন্য বন্ড লাইসেন্স প্রদান, যাতে টুনা, স্যালমন, স্কলপ এবং ভ্যানমেই শ্রিম্পের মতো কাঁচামাল ডিউটি-মুক্ত আমদানি করা যায়।
লং-লাইনার অনুমোদন সরলীকরণ: দ্রুত অনুমোদন প্রক্রিয়া, গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষ লাইসেন্স নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে প্রদান।
কক্সবাজারে জেটি উন্নয়ন: খুরুশকুলে ডিপ-সি ট্রলার জেটির দ্রুত অনুমোদন, ম্যারিকালচার (সমুদ্রীয় জলজ চাষ) ও অফশোর অপারেশন সহজতর করা।
অন্যান্য সংস্কার: স্থানীয় বাই-ক্যাচ প্রজাতির প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানি অনুমতি, বিদ্যুৎ ট্যারিফ হ্রাস এবং IUU (অবৈধ, অরিপোর্টেড ও অনিয়ন্ত্রিত) মৎস্য আহরণ রোধে সকল জাহাজের বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন।
MIDA মাস্টার প্ল্যান: মহেশখালী-মাতারবাড়ির অর্থনৈতিক রূপান্তর
MIDA-এর মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, মহেশখালী ও মাতারবাড়ি অঞ্চলে ৪টি মূল স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলা হচ্ছে:
ডিপ-সি পোর্ট ও লজিস্টিকস: মাতারবাড়ি পোর্টের গভীরতা ১৮.৫ মিটার, যা বড় জাহাজ আটকাতে সক্ষম। এটি আমদানি-রপ্তানির খরচ ৩৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে।
ম্যানুফ্যাকচারিং: শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক জোন গঠন, যা ৪৭–৪৮ বিলিয়ন ডলার বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ করবে।
শক্তি ও এনার্জি: ৮–১০ MTPA পেট্রোলিয়াম রিফাইনারি ও নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প, যা জাতীয় চাহিদার ৩৫% পূরণ করবে।
গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষ ও প্রসেসিং: বঙ্গোপসাগরের ৭% মৎস্য সম্পদ ব্যবহার, স্কলপ প্রসেসিংয়ে ৫০০ মিলিয়ন ডলার রপ্তানি সম্ভাবনা।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (JICA)-এর গবেষণা অনুসারে, পরবর্তী ২০–৩০ বছরে প্রকল্পে ৬০–৬৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ হতে পারে, যার ১০% বিদেশি বিনিয়োগ। এটি কক্সবাজারের পর্যটনকে ১.৫ গুণ বাড়াবে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সংযোগ বাড়াবে।
চ্যালেঞ্জ ও টেকসই উন্নয়ন
জলবায়ু পরিবর্তন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও IUU মৎস্য আহরণ গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষে ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। বিদেশি প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা অর্থনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। তবে ন্যাশনাল ব্লু ইকোনমি অ্যাকশন প্ল্যান এবং ব্লু বন্ডস-এর মতো উদ্যোগ এই ফাঁক পূরণে সহায়ক হবে।
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের মতে, “মৎস্য মন্ত্রণালয় গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষে আরও ফোকাস করবে। সম্ভাব্য জোন চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে প্রযুক্তি স্থানান্তর করা প্রয়োজন।”
ভবিষ্যৎ ও সামাজিক প্রভাব
MIDA-এর উদ্যোগ শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক ও পরিবেশগত রূপান্তরেরও প্রতীক। বিএফডিসি ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে এটি ভ্যালু-অ্যাডেড পণ্য যেমন স্মোকড ফিশ ও রেডি-টু-ইট সীফুডের রপ্তানি বাড়াবে। আন্তর্জাতিক ‘ব্লু ডিপ্লোম্যাসি’-এর মাধ্যমে প্রযুক্তি স্থানান্তর ও IUU নিয়ন্ত্রণে সহায়তা বাড়ানো হবে।
স্থানীয় মৎস্যজীবী এবং শিল্পপতি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। কক্সবাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, “নতুন পোর্ট আমাদের ফ্রোজেন ফিশ শিপমেন্টের সময় কমাবে এবং রপ্তানি বাড়াবে।” MIDA সুপারিশগুলোকে বাস্তবায়ন রোডম্যাপে রূপান্তর করবে এবং নিয়মিত ফলো-আপ নিশ্চিত করবে।
বঙ্গোপসাগরের নীল সম্পদ দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। MIDA-এর উদ্যোগ গভীরসমুদ্র মৎস্যচাষ ও প্রসেসিং শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানের একটি শিল্পে পরিণত করতে চলেছে, যা বাংলাদেশের নীল অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবে।