জুলাই যোদ্ধার ত্যাগ প্রকাশ পেল রাস্তায়

আতিকুল ইসলাম: জুলাইয়ের হাসির পিছনে লুকিয়ে ছিল অদম্য সাহস, আজ লাঠির আঘাতে ভেঙে পড়ল কৃত্রিম হাত।

টুইট প্রতি‌বেদক: ১৯ বছর বয়সী জুলাই যোদ্ধা আতিকুল ইসলামের (পরিচিতি: আতিক) মুখে হাসি—এই হাসিটি বাংলাদেশের যুবসমাজের জন্য এক প্রতীক হয়ে উঠেছিল।

২০২৪ জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনের রক্তাক্ত রাস্তায় তার হাতে পুলিশের গুলি লাগার পরও তিনি বলেছিলেন,

“এক হাত কেটে ফেলতে হয়েছে তো কী হয়েছে, আরেকটা হাত আছে। জীবনটাও আছে। অনেকে তো জীবনটাই হারিয়ে ফেলছেন। আর দেশের প্রয়োজনের সময় কিছু একটা করতে পারলাম, এইটাই তো অনেক।”

কিন্তু শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) সংসদ ভবনের সামনে ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে পুলিশের লাঠিচার্জে তার কৃত্রিম হাতটি খুলে রাস্তায় পড়ে যায়।

এই ঘটনা শুধু আতিকুলের ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, বরং আন্দোলনের ত্যাগীদের প্রতি রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততার প্রতীক হয়ে উঠেছে। অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও এবং ছবি দেখে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, এবং অনেকে অন্তর্বর্তীকারী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসকে লক্ষ্য করে “ধিক্কার” জানাচ্ছেন।

আতিকুলের যাত্রা

গুলির আঘাত থেকে কৃত্রিম হাত পর্যন্ত আতিকুল ইসলামের গল্প শুরু হয় ৫ আগস্ট ২০২৪-এ, যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। সেদিন বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার কাছে আতিকুলের বাম হাতে পুলিশের গুলি লাগে। তখন তিনি মাত্র ১৮ বছরের যুবক, আন্দোলনের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। আহত অবস্থায় তাকে নিয়ে আন্দোলনকারী সংগী এবং পরে স্বজনরা পাঁচটি হাসপাতাল ঘুরে বেড়ান। একটি হাসপাতালে চিকিৎসকরা গুলিটি বের করেন, কিন্তু ক্ষতির গভীরতা দেখে ৬ আগস্ট দুপুরে তাকে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। পরের দিন, ৭ আগস্ট, অস্ত্রোপচার করে তার হাতটি কেটে ফেলতে হয়। এই ঘটনার পর আতিকুলের হাসি এবং তার বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়, যা যুবকদের মধ্যে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে।
পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় ব্র্যাকের সহায়তায় তিনি কৃত্রিম হাত লাগান, যা তিনি দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করছিলেন। জুলাই আন্দোলনের আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত আতিকুল এবং তার সংগীদের মধ্যে এখনো চলছে বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং স্মৃতি স্বীকৃতির দাবি। ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ছিল সেই দাবির একটি অংশ, যেখানে তারা সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি চেয়েছিলেন।

শুক্রবারের সংঘর্ষ, লাঠির আঘাতে কৃত্রিম হাত বিচ্ছিন্ন

শুক্রবার দুপুরে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই যোদ্ধারা জড়ো হন সনদ স্বাক্ষরের জন্য। পুলিশ তাদের প্রবেশে বাধা দেয়, যাতে সংঘর্ষ শুরু হয়। লাঠিচার্জের মধ্যে আতিকুলের কৃত্রিম হাত খুলে রাস্তায় পড়ে যায়, এবং এই দৃশ্যের ভিডিও ইউটিউবে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আতিকুল নিজে বলেছেন, “আমার একটা হাত নাই, আর্টিফিশিয়াল হাত, এটাও ওরা বাড়ি মেরে ভেঙে দিল।” এতে আহত হন প্রায় ২০ জন যোদ্ধা, যাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সংঘর্ষের পর দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং মামলা শুরু হয়েছে।

অনলাইন-অফলাইন ক্ষোভ:

‘ধিক্কার’ এবং #PoliceBrutality, এই ঘটনা অনলাইনে ঝড় তুলেছে। X (পূর্বে টুইটার)-এ #JulyWarrior, #ArtificialHand এবং #PoliceBrutality হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে। একটি পোস্টে বলা হয়েছে, “পুলিশের গুলিতে হাত হারানো আতিকুলের কৃত্রিম হাত আজ আবারো পুলিশ দিয়ে বর্বরোচিত ভাবে পিটিয়ে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে!” অনেকে সরকারকে দায়ী করছেন, বলছেন, “যাদের ত্যাগ আর রক্তের উপরে দাঁড়িয়ে আজকে এই সরকার তাদের সাথেই এই আচরণ সরকারের। ধিক এই সরকারকে। ধিক প্রফেসর ইউনুস।”

অফলাইনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ক্যাম্পাসগুলোতে প্রতিবাদ সভা হয়েছে। বিরোধী গোষ্ঠীগুলো এটাকে ‘রাষ্ট্রীয় সহিংসতা’ বলে অভিহিত করেছে।

সরকারের নীরবতা: কী হবে পরবর্তী?

অন্তর্বর্তীকারী সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসেনি। আতিকুলের মতো যোদ্ধাদের দাবি—বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং স্মৃতি স্বীকৃতি—যদি উপেক্ষা করা হয়, তাহলে নতুন করে আন্দোলনের ঢেউ উঠতে পারে।

আতিকুলের হাসি আজও অনুপ্রেরণা, কিন্তু তার কৃত্রিম হাত রাস্তায় পড়ে থাকা ছবিটি যেন বলছে, ত্যাগের ফল কি এমন অবিচার? সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে, নয়তো জুলাইয়ের আত্মা আবার জেগে উঠবে।