জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫: গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের রোডম্যাপ
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫: বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের রোডম্যাপ ।
টুইট প্রতিবেদক: বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব অধ্যায় যুক্ত হয়েছে আজ ১৭ অক্টোবর জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
এই ৪০ পৃষ্ঠার বিস্তৃত নথিটি ৩২টি রাজনৈতিক দল ও হজাতের ঐকমত্যের ফসল, যা ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ২০২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের একটি সমন্বয়মূলক রোডম্যাপ।
সনদটি ফ্যাসিস্ট শাসনের পুনরাবৃত্তি রোধ করে গণতান্ত্রিক সংস্কারের প্রত্যয় দেয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে সাতটি মূল প্রতিশ্রুতিতে বেঁধে দেয়:
জনপ্রতিনিধিত্বের মর্যাদা রক্ষা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার, দুর্নীতি দমন, নির্বাচনী সততা, মানবাধিকার রক্ষা, অংশগ্রহণমূলক শাসন এবং জাতীয় ঐক্য।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ১৪ অক্টোবর ২০২৫ তারিখের প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশিত এই সনদটি দেশের সাংবিধানিক, নির্বাচনী, বিচারব্যবস্থা, জনেশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
এটি শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের প্রতীক নয়, বরং জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনাকে সংরক্ষণ করে ভবিষ্যতের গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ার মাইলফলক। নিম্নে সনদের পটভূমি, গঠনপ্রক্রিয়া, মূল বিষয়বস্তু এবং চ্যালেঞ্জগুলোর বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো।
গণতান্ত্রিক সংগ্রামের দীর্ঘ পথ
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাংলাদেশের ৭৭ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের সারাংশ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫-এর একদলীয় শাসন, ১৯৯০-এর গণতান্ত্রিক পুনরুদ্ধার, ২০০৬-এর জুলাই গণআন্দোলন এবং ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান – এই সব ঘটনা সনদের ভিত্তি। সনদটি ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসনের সমালোচনা করে বলে, এই সময়কালে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪), দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দলীয়করণের ফলে গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থান ছাত্র-শ্রমিক-নারী-হিসাবজীবীদের অংশগ্রহণে সফল হয়েছে, যা শাসকগোষ্ঠীর পতন ঘটিয়েছে। এই অভ্যুত্থানে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ এবং অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের তৎপর ভূমিকা ছিল। অভ্যুত্থানের ফলে সংস্কারের দাবি উঠেছে – সাংবিধানিক সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার, বিচারব্যবস্থা সংস্কার ইত্যাদি। এর ফলে ২০২৪-এর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় এবং ৩ অক্টোবর ২০২৪-এ ছয়টি সংস্কার কমিশন (পার্টি সংস্কার, নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ সংস্কার, দুর্নীতি দমন) গঠিত হয়। ৭ অক্টোবর ২০২৪-এ সাংবিধানিক সংস্কার কমিশন যুক্ত হয়। এই কমিশনগুলো ৩১ জানুয়ারি ২০২৫-এ প্রতিবেদন জমা দেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের গঠন ও কার্যক্রম
২০২৫-এর ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নির্দেশে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয়, যার চেয়ারম্যান ড. আলী রিয়াজ। কমিশনে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রধান ও সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত।
উদ্দেশ্য: সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশভিত্তিক রাজনৈতিক ঐক্য গঠন। কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫-এ ৩৭টি রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানায়। ৫ মার্চ ২০২৫-এ ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, যার মধ্যে সাংবিধানিক সংস্কারে ৭০টি, মানবাধিকারে ২৭টি, বিচারব্যবস্থায় ২৩টি, জনেশাসনে ২৬টি এবং দুর্নীতি দমনে ২০টি।
কমিশন ৩৩টি দলের সঙ্গে ৪৪টি সভায় আলোচনা করে এবং ৩০টি দলের ঐকমত্যে সনদ প্রস্তুত করে। আলোচনায় ২৩টি বৈঠক হয়েছে, যাতে ৩০টি দল অংশ নিয়েছে। সনদে ২০টি সাংবিধানিক বিষয়ে ঐক্য হয়েছে, যদিও কিছু মতভেদ (যেমন উচ্চকোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা) রয়েছে।
সাতটি প্রতিশ্রুতি ও বিস্তারিত সংস্কার
সনদটি সাতটি মূলনীতিতে দলগুলোকে বেঁধে দেয়। নিম্নে বিস্তারিত:
ক. সাংবিধানিক সংস্কার (অনুসূচি ৬ক):
ভাষা: বাংলা রাষ্ট্রভাষা, অন্যান্য ভাষা স্বীকৃতি। ৩২টি দল ঐক্যবদ্ধ।
নাগরিকত্ব: ‘বাঙালি’ শব্দ বাদ দিয়ে ‘বাংলাদেশি’। ২৯টি দল সমর্থন।
সংশোধন: সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ এবং উচ্চকোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। ৩০টি দল সমর্থন।
অধীনস্থ: ৭ক ও ৭এ মুছে ফেলা। ২৯টি দল ঐক্য।
ক্রমান্বয়ী/অস্থায়ী: ১৫০(২) মুছে ফেলা, ৫ম-৭ম তফসিল বাতিল। ২৩টি দল সমর্থন।
জরুরি অবস্থা: ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ, মৌলিক অধিকার অলঙ্ঘনীয়। ২৯টি দল ঐক্য।
মূলনীতি: সাম্য, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, ধর্মীয় স্বাধীনতা। ২৪টি দল সমর্থন।
বহু-জাতি-ধর্ম-ভাষা-সংস্কৃতির সম্প্রীতি। ২৯টি দল ঐক্য।
মানবাধিকার চুক্তি বাস্তবায়ন। ২৯টি দল সমর্থন।
খ. রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকার ব্যবস্থা:
রাষ্ট্রপতি: দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ থেকে নির্বাচিত, নিরপেক্ষতা নিশ্চিত। ২৯টি দল ঐক্য।
প্রধানমন্ত্রী: দশ বছরের সীমা, দলীয় পদ থেকে মুক্তি। ৩০টি দল সমর্থন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার: নির্বাচনের ৯০ দিন আগে গঠন, ৯০ দিনের মেয়াদ, র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং। বিস্তারিত নিয়মাবলী (১৬টি দফা)। ২৮-৩০টি দল ঐক্য।
গ. আইনসভা (দ্বিকক্ষ):
দ্বিকক্ষ সংসদ: জাতীয় সংসদ (মৌলিক) ও মহাসভা (উচ্চকোষ্ঠ্য, ১০০ সদস্য, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব)। ২৫টি দল সমর্থন।
মহাসভার ভূমিকা: আইন পর্যালোচনা, সংশোধনী, বিল স্থগিতকরণ (২ মাস)। ২৪টি দল ঐক্য।
স্থায়ী কমিটি: সভামত্তিক নির্বাচন। ৩০টি দল সমর্থন।
সংসদীয় আসন: নারী আসন ১০০-এ উন্নীত। ৩০টি দল ঐক্য।
নারী প্রতিনিধিত্ব: ৩৩% সংরক্ষণ, ৫% নারী প্রার্থী। ২৬টি দল সমর্থন।
ঘ. মানবাধিকার ও বিচারব্যবস্থা:
জরুরি অবস্থায় অধিকার সুরক্ষা। ২৯টি দল ঐক্য।
বিচারক নিয়োগ: জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন (জেএসি) গঠন। ২৯টি দল সমর্থন।
বিচারকদের স্বাধীনতা: পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত। ৩১টি দল ঐক্য।
স্থায়ী বিচার বিভাগ: সুপ্রিম কোর্টে স্থায়ী বেঞ্চ। ২৯টি দল সমর্থন।
বিচারকদের বেতন: সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি। ৩০টি দল ঐক্য।
স্বতন্ত্র তদন্ত কমিশন: হত্যা-অপরাধ তদন্তের জন্য। ৩০টি দল সমর্থন।
ঙ. নির্বাচন ব্যবস্থা:
নির্বাচন কমিশন: স্বাধীন, ৯ সদস্য, র্যাঙ্কড চয়েস ভোটিং। ৩০টি দল ঐক্য।
নির্বাচনী এলাকা: ১০ বছরে পুনর্নির্ধারণ। ২৯টি দল সমর্থন।
দলীয় প্রতীক: দুর্নীতিবাজদের প্রতীক বাতিল। ৩২টি দল ঐক্য।
ভোটার তালিকা: জাতীয় আইডি ভিত্তিক। ৩২টি দল সমর্থন।
চ. জনেশাসন ও পুলিশ:
তথ্য অধিকার আইন সংশোধন। ২৮টি দল ঐক্য।
অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সংশোধন। ২৭টি দল সমর্থন।
জুলাই তদন্ত কমিশন। ৩২টি দল ঐক্য।
জনেশাসন সংস্কার কমিশন। ৩০টি দল সমর্থন।
পুলিশ কমিশন: ৩টি পৃথক কমিশন (সাধারণ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা)। ২৫টি দল ঐক্য।
মন্ত্রিসভা ও মুখ্যমন্ত্রী বিভাগ আলাদা। ৩১টি দল সমর্থন।
ছ. দুর্নীতি দমন:
দুর্নীতি দমন কমিশন: স্বাধীন, ৫ সদস্য। ৩০টি দল ঐক্য।
অর্থের উৎস ঘোষণা বাধ্যতামূলক। ৩১টি দল সমর্থন।
সুদ-বিনিময় আয়ের চুক্তি বাতিল। ৩১টি দল ঐক্য।
বেনিফিশিয়াল ওনারশিপ আইন। ৩২টি দল সমর্থন।
CRS বাস্তবায়ন। ৩২টি দল ঐক্য।
OGP-এ যোগদান। ২৬টি দল সমর্থন।
চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা
সনদে ৩২টি দলের ঐক্য সত্ত্বেও কিছু মতভেদ রয়েছে, যেমন উচ্চকোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৩টি দল বিরোধী), নারী আসন (৪টি দল বিরোধী)। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং চারটি বামপন্থী দল স্বাক্ষর করেনি। সমালোচকরা বলছেন, সনদে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের কিছু মাইলফলক (যেমন বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা) উল্লেখ নেই, যা ইতিহাসের পুনর্লিখনের অভিযোগ তুলেছে। সাংবিধানিক দ্বন্দ্ব (যেমন দ্বিকক্ষ সংসদ) আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। বাস্তবায়নের জন্য সংসদীয় সময়সীমা (২০২৬-এ নির্বাচন) চ্যালেঞ্জ।
নতুন অধ্যায়ের সূচনা
জুলাই সনদ বাংলাদেশকে ফ্যাসিস্ট অতীত থেকে মুক্ত করে গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের পথ দেখায়। এটি যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে স্বচ্ছ নির্বাচন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা এবং দুর্নীতিমুক্ত শাসন নিশ্চিত হবে। তবে অসম্পূর্ণ ঐক্য (আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি) ব্যর্থতার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। ড. ইউনূসের আহ্বান: “এটি আমাদের ঐক্যের উদযাপনের সময়।” দেশবাসী যেন এই সনদকে জীবন্ত করে তোলে – জুলাইয়ের চেতনা অমর হোক।
সূত্র: জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ (জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, ১৪ অক্টোবর ২০২৫) সংশোধনী ছাড়া।