ভারতীয় বিনিয়োগ অঞ্চল বাতিল, জমি ফিরল বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে

বাংলাদেশের মিরসরাই ও মোংলায় ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্প বাতিল: এক দশকের স্থবিরতার অবসান ও নতুন দিগন্তের সূচনা।
টুইট প্রতিবেদক: দীর্ঘ এক দশকের অচলাবস্থার পর অবশেষে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক (G2G) দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্প—চট্টগ্রামের মিরসরাই (৯০০ একর) এবং বাগেরহাটের মোংলা (১১০ একর)—চূড়ান্তভাবে বাতিল করেছে।
বাংলাদেশ ইকোনমিক জোনস অথরিটি (BEZA) নিশ্চিত করেছে, উভয় প্রকল্পই এখন সরকারি নিয়ন্ত্রণে ফিরে এসেছে এবং নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনার আওতায় পুনর্বিন্যাস করা হবে।
সরকারি ঘোষণা ও প্রেক্ষাপট
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর ২০২৫) সকালে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (BIDA) ও BEZA-এর যৌথ ব্রিফিংয়ে BEZA-এর নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন,
“ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পগুলো G2G ফ্রেমওয়ার্ক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মিরসরাইয়ের ৯০০ একর এবং মোংলার ১১০ একর জমি এখন নতুন পরিকল্পনার জন্য উন্মুক্ত।”
তিনি আরও জানান, ভারতের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় অনুমোদন ও কার্যক্রমের অভাবে প্রকল্প দুটি বছরের পর বছর স্থবির ছিল। অবশেষে LoC রিভিউ মিটিং-এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এগুলো বাতিল করা হয়েছে।
প্রকল্পের ইতিহাস: ২০১৫ সালের চুক্তি থেকে ২০২৫-এর সমাপ্তি
২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (Special Economic Zone) স্থাপনের একটি G2G (Government to Government) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চল বরাদ্দে সম্মতি দেন।
প্রাথমিকভাবে মোংলা বা রামপালে ১০০–৩০০ একর জমির প্রস্তাব থাকলেও পরবর্তীতে নির্ধারিত হয়—
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে: ৯০০ একর
বাগেরহাটের মোংলায়: ১১০ একর
এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে শিল্প বিনিয়োগে উৎসাহিত করা এবং অটোমোবাইল, ফুড প্রসেসিং, টেক্সটাইল, লজিস্টিকস ও ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ আনা।
আর্থিক কাঠামো ও অংশীদারিত্ব
মিরসরাই প্রকল্প
মোট ব্যয়: ৯৬৪.৮৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সরকারের অবদান: ৫০.২৬ কোটি টাকাভ
ভারতের অবদান (LoC ঋণ): ৯১৪.৫৯ কোটি টাকা।
ডেভেলপার: অ্যাডানি পোর্টস অ্যান্ড SEZ লিমিটেডভ
কনসালট্যান্ট: মাহিন্দ্রা কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড।
স্থানীয় অংশীদার: SBG ইকোনমিক জোন লিমিটেড।
মোংলা প্রকল্প:
জমি: ১১০ একর
ভারতের অর্থায়ন: ৪৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার
ডেভেলপার: হিরানন্দানি গ্রুপ
স্থানীয় অংশীদার: SBG ইকোনমিক জোন লিমিটেড
কেন প্রকল্পগুলো বাতিল হলো?
অগ্রগতির অভাব
চুক্তি হওয়ার পর ১০ বছরেও প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। মিরসরাই অঞ্চলে জমি প্রস্তুত ও অবকাঠামো উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা ভারতীয় কোম্পানিগুলো—অ্যাডানি পোর্টস ও ইন্টারন্যাশনাল সিপোর্ট ড্রেজিং—২০২৩ সালের মধ্যে কাজ শুরু না করায় প্রকল্প থমকে যায়।
ভারতের অসহযোগিতা
বাংলাদেশ একাধিকবার ভারতকে প্রস্তাব দিয়েছিল আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান বা স্থানীয় কনট্রাক্টর অন্তর্ভুক্তির অনুমতি দেওয়ার জন্য, কিন্তু ভারত কোনো সাড়া দেয়নি। BEZA-এর কর্মকর্তারা এটিকে “অযৌক্তিক শর্ত ও প্রশাসনিক অনিচ্ছা” বলে অভিহিত করেছেন।
LoC রিভিউ বৈঠক
২০২৪ সালের ৫–৬ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত Line of Credit (LoC) রিভিউ মিটিংয়ে দুই দেশ সম্মত হয় যে, অনুমোদিত কিন্তু বাস্তবায়নহীন প্রকল্পগুলো LoC থেকে বাদ দেওয়া হবে।
ফলে ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্প দুটি ডিলিস্টেড (delisted) হয়।
আর্থিক অনিয়ম ও ঋণ জট
স্থানীয় অংশীদার SBG ইকোনমিক জোন লিমিটেড BEZA-এর কাছে ৮৫ কোটি টাকার বকেয়া ঋণে জড়িয়ে পড়ে। চুক্তি অনুযায়ী জমির ডেভেলপমেন্ট খরচ পরিশোধ না হওয়ায় BEZA তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা
বিদ্যুৎ সংযোগ, রেললাইন, বন্দর লজিস্টিকসসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয়ভার ও দায়িত্ব ভাগাভাগি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়।
বাতিলের প্রক্রিয়া
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর থেকে BEZA অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে প্রকল্প বাতিলের প্রস্তাব পাঠায়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশে ভারতের সম্মতি চাওয়া হলেও কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না পাওয়ায় বাংলাদেশ একতরফা সিদ্ধান্তে প্রকল্প দুটি বাতিল করে।
বর্তমানে মিরসরাই ও মোংলার জমি সম্পূর্ণভাবে BEZA-এর নিয়ন্ত্রণে ফিরে এসেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মিরসরাই:
৯০০ একর জমি এখন ‘জাতীয় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (NSEZ)’ হিসেবে পুনঃপরিকল্পিত হচ্ছে।
সরকার এখানে একটি ‘গ্রিন ফ্যাক্টরি হাব’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা পরিবেশবান্ধব শিল্প স্থাপনার আদর্শ মডেল হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মাস্টার ডেভেলপার নিযুক্ত করা হবে, যিনি বিদেশি ও দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে সমন্বয়ে শিল্প কারখানা স্থাপন করবেন।
এছাড়া সরকার মিরসরাই থেকে শুরু করে দেশের সব অর্থনৈতিক অঞ্চলে রেল সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।
মোংলা
১১০ একর জমির নতুন ব্যবহার এখনো নির্ধারণ করা না হলেও, স্থানীয় শিল্পোন্নয়ন, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এবং বন্দরনির্ভর বিনিয়োগ প্রকল্পের সম্ভাবনা বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
বিশ্লেষণ ও প্রতিক্রিয়া
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও নীতি-নির্ধারণে স্বনির্ভরতার বার্তা বহন করে। দীর্ঘদিনের অচল প্রকল্প বাতিলের মাধ্যমে সরকার এখন স্থানীয় উদ্যোক্তা ও নতুন বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করতে পারবে।
অন্যদিকে, ভারতীয় সূত্রগুলো এই সিদ্ধান্তকে “প্রশাসনিক সমন্বয়হীনতা ও অর্থনৈতিক বাস্তবতার ফলাফল” হিসেবে ব্যাখ্যা করছে।
তবে, কূটনৈতিক মহলে এটি বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের মধ্যে সামান্য উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত সাম্প্রতিক আমদানি–রপ্তানি বিধিনিষেধ, ভিসা প্রক্রিয়া জটিলতা এবং শুল্কবিষয়ক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে।
এক দশক ধরে স্থবির থাকা ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রকল্পের বাতিল বাংলাদেশের শিল্পনীতিতে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এটি দেশের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, বিনিয়োগ কাঠামো ও বিদেশি সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন বাস্তবতা তৈরি করবে।







