বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ অনুশীলন বাড়বে

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ যৌথ সামরিক অনুশীলন: ইন্দো-প্যাসিফিকের স্থিতিশীলতায় নতুন অধ্যায়

নিজস্ব প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান সামরিক অনুশীলন এবং কূটনৈতিক সংলাপ দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা সহযোগিতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের যৌথ অনুশীলন—‘টাইগার শার্ক ২০২৫’, ‘টাইগার লাইটনিং ২০২৫’ এবং ‘প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫’—দুই বাহিনীর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা, দক্ষতা ও কৌশলগত সমন্বয়কে আরও জোরদার করেছে। এই সহযোগিতা শুধু দ্বিপাক্ষিক নয়, বরং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বৃহত্তর কাঠামোয় যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

বিশেষ বাহিনীর যৌথ প্রশিক্ষণ: ‘টাইগার শার্ক ২০২৫’

২০২৫ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ছবিগুলোতে দেখা যায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিশেষ বাহিনী (প্যারা কমান্ডো ব্রিগেড) এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্পেশাল ফোর্স যৌথভাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

এই অনুশীলনটি ২০০৯ সাল থেকে চলমান “ফ্ল্যাশ বেঙ্গল সিরিজ”-এর অংশ, যেখানে দুই দেশের বিশেষ বাহিনী পেট্রোল বোট পরিচালনা, ক্ষুদ্র অস্ত্রের যুদ্ধকৌশল এবং সংকট প্রতিক্রিয়া সক্ষমতা অনুশীলন করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানায়, এই অনুশীলন দুই দেশের প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করছে এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।

টাইগার লাইটনিং ২০২৫’: বাস্তব যুদ্ধ প্রস্তুতির অনুশীলন

আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত ‘টাইগার লাইটনিং ২০২৫’ (TL25) ছিল বছরব্যাপী দ্বিপাক্ষিক কর্মসূচির অংশ, যা মূলত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, জঙ্গল যুদ্ধ, চিকিৎসা সহায়তা এবং আইইডি প্রতিরোধের মতো আধুনিক সামরিক দক্ষতার উপর ফোকাস করেছে।

এই মহড়া যুক্তরাষ্ট্র প্যাসিফিক সেনাবাহিনীর (USARPAC) থিয়েটার আর্মি ক্যাম্পেইন প্ল্যান (TSCP)-এর অংশ, যার লক্ষ্য সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে অপারেশনাল প্রস্তুতি বাড়ানো।
অংশগ্রহণকারীরা জানান, এই প্রশিক্ষণ শুধু সামরিক প্রস্তুতি নয়, বরং দুই দেশের সেনাদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব এবং বিশ্বাস গঠনের ক্ষেত্রেও একটি বড় পদক্ষেপ।

প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫’: মানবিক সহায়তা ও বিমান নিরাপত্তা অনুশীলন

সেপ্টেম্বর মাসে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘প্যাসিফিক অ্যাঞ্জেল ২৫’ অনুশীলনে যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কার প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এক সপ্তাহব্যাপী এই অনুশীলনের মূল লক্ষ্য ছিল মানবিক সহায়তা, অনুসন্ধান ও উদ্ধার (SAR) এবং বিমানভিত্তিক চিকিৎসা কার্যক্রম।

এই প্রোগ্রামটি দুই দেশের বিমানবাহিনীর পেশাদার দক্ষতা বিনিময় ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

১৯ সেপ্টেম্বর অনুশীলন সফলভাবে সমাপ্ত হয়, যা বাংলাদেশের দুর্যোগ প্রতিক্রিয়া সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে।

৯ম ল্যান্ড ফোর্সেস টকস: বিশ্বাস ও সহযোগিতার নতুন প্ল্যাটফর্ম

২০২৫ সালের ৮–১০ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের ফোর্ট শ্যাফটারে অনুষ্ঠিত হয় “৯ম ইউএস প্যাসিফিক আর্মি–বাংলাদেশ আর্মি ল্যান্ড ফোর্সেস টকস”।

সংলাপে অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের মেজর জেনারেল স্কট এ. উইন্টার এবং বাংলাদেশের ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. হুমায়ুন কবির। আলোচনায় সামরিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি বিনিময় ও যৌথ অপারেশনাল পরিকল্পনা নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়।

মেজর জেনারেল উইন্টার বলেন—“বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্ব ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের নিরাপত্তা সহযোগিতার প্রতীক।”

অন্যদিকে, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হুমায়ুন কবির বলেন—“এই সংলাপ আমাদের সামরিক সহযোগিতাকে বাস্তব রূপ দিয়েছে, যা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত হবে।”

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা

২০১৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রায় ৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফরেন মিলিটারি ফাইন্যান্সিং (FMF) এবং ১৪.৫ মিলিয়ন ডলার ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং (IMET) সহায়তা দিয়েছে।

এই সহায়তার আওতায় রয়েছে—৪৬টি MRAP যানবাহন ও ১১টি মাইন রোলার, আধুনিক পেট্রোল বোট, RQ-21 Blackjack ড্রোন মোতায়েন এবং শান্তিরক্ষা মিশনের জন্য উন্নত সরঞ্জাম সরবরাহ।

বাংলাদেশ বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ৬,৫০০-এরও বেশি সেনা সদস্য নিয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অবদানকারী দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জাম এই সক্ষমতাকে আরও সুদৃঢ় করছে।

ভারত ও মিয়ানমারের উদ্বেগ

যদিও যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সামরিক সহযোগিতা “মুক্ত ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক” নীতির অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে, প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার এই ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্বকে কৌশলগত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছে।
চট্টগ্রামে C-130J সুপার হারকুলিস বিমানের অবতরণ এবং প্রায় ১২০ মার্কিন সেনা ও বিমানকর্মীর উপস্থিতি নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু সংবাদমাধ্যম “গোপন মিশন” হিসেবে সংবাদ প্রকাশ করেছে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের অফিসিয়াল অবস্থান অনুযায়ী, এই উপস্থিতি কেবলমাত্র রুটিন প্রশিক্ষণ এবং মানবিক সক্ষমতা উন্নয়নের অংশ।

যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সামরিক সম্পর্ক এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। যৌথ অনুশীলনগুলো শুধু প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নয়, বরং আস্থা, বন্ধুত্ব এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রতীক হয়ে উঠছে।

এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা অঙ্গনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।