ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি হামলা: বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ, নাবিকদের বার্তা

‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নৌবহরের নাবিকদের মন্তব্য, যাত্রা ও অভিজ্ঞতা

টুইট প্রতিবেদন: ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নৌবহরের নাবিকরা (স্বেচ্ছাসেবক যাত্রীরা) গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙতে এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর লক্ষ্যে যাত্রা করেন, যা তাদের জন্য একটি গভীর আবেগীয় এবং সংহতির যাত্রা।

৪৪টি দেশের প্রায় ৫০০ নাবিক, যাদের মধ্যে সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, স্পেনের সাবেক মেয়র আদা কোলাউ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও মানবাধিকার কর্মীরা ছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে এই যাত্রা শুধু সহায়তা বহনের নয়, বরং গাজার লোকদের প্রতি সংহতি ও আশার প্রতীক।

নাবিকরা বলেন, “এই অভিযানে আমরা শুধু জাহাজ চালাই না, আমরা আশা বহন করি।” ২০২৫ সালের ৩১ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া এই যাত্রায় নাবিকরা ড্রোন আক্রমণ, যোগাযোগ জ্যামিং এবং হুমকির মুখোমুখি হন, কিন্তু তাদের সংকল্প অটুট ছিল।

যাত্রার শুরু এবং প্রাথমিক অভিজ্ঞতা

নৌবহরের যাত্রা শুরু হয় স্পেনের বার্সেলোনা এবং ইতালির জেনোয়া থেকে, যেখানে নাবিকরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন যে এটি একটি “জীবনের লড়াই”। ইয়ুসুফ ওমর, একজন নাবিক, ভিডিওতে বলেন, “গাজায় পৌঁছে আমরা যা দেখব, তা ফিলিস্তিনিদের দৈনন্দিন জীবনের সত্যতা প্রতিফলিত করবে—বোমা, অনাহার এবং মৃত্যু। কিন্তু আমরা এখানে আশা নিয়ে আসছি।” নাবিকরা ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করার সময় ক্রিট দ্বীপের কাছে ড্রোন আক্রমণের শিকার হন, যা তাদের মতে “মনোবৈজ্ঞানিক অপারেশন”।

এক নাবিক বলেন, “আমরা ফ্যামিলিয়া জাহাজে থাকা ২৮ জন সবাই ডেকে জড়ো হয়ে সিদ্ধান্ত নিই—কেউই ভয় পাইনি, কেউই নামব না। এই যাত্রা আমাদের থেকে বড়।” এই অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে একটি অটুট বন্ধন গড়ে তোলে।

আক্রমণের সময়কার তীব্র অভিজ্ঞতা

১ অক্টোবর রাতে ইসরায়েলি নৌবাহিনীর আক্রমণের সময় নাবিকরা তীব্র ভয়, কিন্তু অটল সংকল্পের মুখোমুখি হন। নৌবহরের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করা মন্তব্যে বলা হয়, “ফাটাকাটা, অজানা ড্রোন এবং যোগাযোগ জ্যামিং—আমরা এগুলো সামনাসামনি দেখছি, কিন্তু আমরা ভয় পাব না। ইসরায়েলের এই চেষ্টা গাজায় অনাহার এবং গণহত্যা দীর্ঘায়িত করার জন্য, কিন্তু আমাদের সংকল্প আরও শক্তিশালী।” ওমর ফারিস, একজন ভেটেরান অ্যাকটিভিস্ট, বলেন, “আমাদের লড়াই জীবন, মর্যাদা এবং দখলমুক্ত ভবিষ্যতের জন্য। নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত ফিলিস্তিন মুক্ত হবে। গাজার দিকে চোখ রাখুন।” নাবিকরা আটকের পরও বলেন, এই আক্রমণ “ইসরায়েলের হতাশার প্রকাশ” এবং এটি তাদের মিশনকে আরও শক্তিশালী করেছে।

গাজার লোকদের প্রতি সংহতি এবং আশা

নাবিকরা তাদের যাত্রাকে গাজার বাসিন্দাদের আশার প্রতীক হিসেবে দেখেন। এক পোস্টে বলা হয়, “কল্পনা করুন, আপনি গাজার তীরে দাঁড়িয়ে আছেন—তিন বছর বোমা থেকে বেঁচে, মাসের পর মাস অনাহার সহ্য করে—এবং শোনেন যে গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা আসছে আপনাকে উদ্ধার করতে। আপনি তীর ছাড়বেন না।” ডক্টর নাগহাম আবু হামিলা, গাজা থেকে রিপোর্ট করে বলেন, “আমরা গাজা সিটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি বোমাবর্ষণের কারণে—যা আমরা দেখেছি, তা অবর্ণনীয়। কিন্তু ফ্লোটিলা আমাদের আশা দেয়।” নাবিক ক্যামিলা বলেন, “আমরা বাড়িতে বসে থাকতে পারছিলাম না, যখন আমাদের সরকারগুলো এই গণহত্যা স্পনসর করছে। এই যাত্রা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”

বিশ্বব্যাপী সমর্থন এবং নাবিকদের বার্তা

নাবিকদের অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী সমর্থন জাগিয়েছে। ফ্রান্সেসকা আলবসের মতো সমর্থকরা বলেন, “আমরা তোমাদের সাথে আছি—আত্মায় এবং আশায়। তোমরা একা নও।” জিব্রিল সালিসু নাইনা বলেন, “এই সাহসী আত্মারা অবরোধ ভাঙতে যাচ্ছে—তারা চিরকাল মনে থাকবে অটুট স্বাধীনতা যোদ্ধা হিসেবে। গাজা মুক্ত হবে।” নাবিকরা বলেন, “এই মিশন শুধু মানুষের—ভূমি, আকাশ এবং সমুদ্র থেকে আমরা গাজায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। এটি শেষ নয়, যতক্ষণ না ফিলিস্তিন মুক্ত হয়।” এন ডুয়েলের মতো সমর্থকরা বলেন, “ফ্লোটিলা গাজা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ভাঙার প্রতীক—আমাদের আশা তাদের সাফল্যে।”

নাবিকদের মন্তব্য এবং অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট যে, এই যাত্রা তাদের জন্য একটি রূপান্তরকারী অভিজ্ঞতা—ভয়, আশা এবং সংহতির মিশ্রণ। যদিও আক্রমণে তারা ব্যর্থ হয়, তাদের বার্তা বিশ্বকে গাজার সংকটের প্রতি সচেতন করেছে।

সর্বশেষ ‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ আন্তর্জাতিক জলসীমায় আক্রমণের শিকার হয়ে যাত্রীদের আটক করার পর বিশ্বজুড়ে নতুন করে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এই নৌবহরের ইতিহাসে রয়েছে রক্তাক্ত হামলা, আটক অভিযান, আন্তর্জাতিক নিন্দা এবং কূটনৈতিক চাপ।

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা অভিযান

‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নৌবহরটি ২০২৫ সালের অগাস্ট মাসের শেষের দিকে ইতালি থেকে যাত্রা শুরু করে। এতে ছিল ৪৪টি নৌযান এবং ৫০০-এর বেশি যাত্রী, যাদের মধ্যে সুইডিশ পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ ৪৬টি দেশের নাগরিক ছিলেন। নৌবহরের লক্ষ্য ছিল গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া এবং বিশ্বব্যাপী অবরোধের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি।

নৌবহরটি স্পেনের বার্সেলোনা ও ইতালির জেনোয়া থেকে যাত্রা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে তিউনিস, সিসিলি ও অন্যান্য স্থলবন্দর থেকে আরও নৌযান যুক্ত হয়। মোট সময়কাল ছিল প্রায় ৫ সপ্তাহ। পথে মাল্টা ও ক্রিট দ্বীপের কাছে ড্রোন আক্রমণ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা জ্যামের মতো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় নৌবহরটি।

২০২৫ সালের ১ অক্টোবর রাত ১০টার দিকে, গাজা উপকূল থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে ইসরায়েলি নৌবাহিনী নৌবহরটির উপর আক্রমণ চালায়। নৌযানগুলোতে বোর্ডিং করা হয়, যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত করা হয়, এবং কিছু ক্ষেত্রে ড্রোন ও রাসায়নিক স্প্রে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। আক্রমণের ফলে ৪৪টি নৌযান মধ্যে এক ছাড়া সব জব্দ হয়। আটক যাত্রীদের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং পরে কেটজিওট কারাগারে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে পূর্বে ফিলিস্তিনি বন্দীদের উপর নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।

এই হামলার কারণে সব সহায়তা গাজায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়। ৪৪৩ জনেরও বেশি যাত্রী আটক হন। কয়েকজন আহত হলেও নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন এটিকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, বিশেষ করে ইস্তাম্বুল, রোম, বুয়েনোস আইরেস এবং বার্লিনে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান এটিকে ‘ইসরায়েলের বর্বরতার মুখোশ’ বলে আখ্যা দেন। মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, আয়ারল্যান্ড, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। জাতিসংঘ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এটিকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচনা করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু ইউরোপীয় দেশ নীরব থাকায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

গাজার মানবিক নৌবহর কখনোই নতুন নয়। ২০১০ সালে ‘মাভি মারমারা’ হামলায় ১০ তুর্কি স্বেচ্ছাসেবক নিহত হন। ২০১১ সালে ‘ডিগনিটি আল করামা’, ২০১৫ সালে ‘মারিয়ান অব গথেনবার্গ’, ২০১৮ সালে ‘আল আওদা’ ও ‘ফ্রিডম’, এবং ২০২৫ সালের মে ও জুনে ‘কনসায়েন্স’ ও ‘ম্যাডলিন’ জাহাজও একইভাবে জব্দ হয়। এই ধারাবাহিকতা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলের হস্তক্ষেপের ইতিহাসকে তুলে ধরে।

‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ নৌবহরের আক্রমণ গাজার মানবিক সংকট এবং ইসরায়েলি অবরোধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতির প্রতীক। যদিও সহায়তা গন্তব্যে পৌঁছায়নি, এটি বিশ্বব্যাপী সচেতনতা ও প্রতিবাদের ঢেউ সৃষ্টি করেছে।

সূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, সিএনএন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন, এক্স (পূর্বে টুইটার)