দক্ষিণ এশিয়ায় জেন-জি বিপ্লব: নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার পর লক্ষ্য কোথায়?
দক্ষিণ এশিয়ায় তরুণ প্রজন্ম দুর্নীতি, বৈষম্য ও অচল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একের পর এক আন্দোলনে নামছে; বিশ্লেষকদের প্রশ্ন—এরপর কোন দেশে ফেটে পড়বে বিদ্রোহ?
টুইট প্রতিবেদন: দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে ধারাবাহিক বিদ্রোহ। নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় জেন-জি প্রজন্ম একের পর এক আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের অচল রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
এসব বিদ্রোহের ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপট থাকলেও মূল চালিকাশক্তি ছিল একটি প্রজন্ম, যারা আর প্রথাগত রাজনীতির প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে রাজি নয়।
নেপালে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে শুরু হয় ব্যাপক তরুণ বিদ্রোহ। সরকারের সিদ্ধান্তে প্রায় ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ ঘোষণার পর রাজধানী কাঠমান্ডুসহ বিভিন্ন শহরে হাজারো তরুণ-তরুণী রাস্তায় নেমে আসে। শুরুতে আন্দোলনের দাবিটি ছিল ডিজিটাল স্বাধীনতা, তবে দ্রুত তা রূপ নেয় দুর্নীতি, বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি ও চাকরির সংকটের বিরুদ্ধে এক বৃহৎ গণঅভ্যুত্থানে।
নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে অন্তত ৭০ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়। ক্ষুব্ধ জনতা সংসদ ভবন, গণমাধ্যম অফিস ও রাজনৈতিক নেতাদের বাসভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়।
পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও নতুন নির্বাচনের ঘোষণা আসে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, প্রবাসী তরুণ নেপালিরা ডিসকর্ড প্ল্যাটফর্মে অনলাইন ভোটের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের নজির গড়ে—যা প্রমাণ করে ডিজিটাল মাধ্যমের শক্তি কতটা কার্যকর।
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু পুলিশের দমনপীড়ন ও শত শত প্রাণহানি আন্দোলনকে সরকারের পতনের দাবিতে রূপান্তরিত করে। সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও ব্যাপক দমননীতি চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়।
৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন। আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল বিকেন্দ্রীকৃত, একাধিক ছাত্রনেতার হাতে ছড়িয়ে থাকা। তবু পুরো দেশের তরুণ সমাজ একত্রিত হয়ে দীর্ঘদিনের শাসনের অবসান ঘটায়।
এরও আগে, ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। বৈদেশিক ঋণ খেলাপি হওয়া, মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়া, প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিভ্রাট এবং জ্বালানি-গ্যাস সংকটে দেশের সাধারণ মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
তরুণ প্রজন্ম তখন রাজধানী কলম্বোয় “আরাগালায়া” বা “সংগ্রাম” আন্দোলন শুরু করে। ‘গোটাগোগামা’ নামের প্রতীকী গ্রাম গড়ে তারা প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। জুলাই মাসে প্রেসিডেন্টের বাসভবন দখল করার পর রাজাপক্ষ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
বিশ্লেষকদের মতে, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার এই আন্দোলনগুলোর পেছনে অভিন্ন কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে আছে দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, কর্মসংস্থানের অভাব এবং প্রবীণ নেতৃত্বের সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের অচল সংযোগ। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী ২৮ বছরের নিচে, আর সাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের ওপরে। এই তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা এবং ক্ষোভই আন্দোলনগুলোর প্রধান ভিত্তি তৈরি করেছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, তরুণ প্রজন্মের জীবনযাত্রার বাস্তবতা ও রাজনীতিকদের বিলাসবহুল জীবনের মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি। কোভিড-১৯ মহামারির সময় ঘরে বন্দি থেকে তরুণরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে দক্ষ হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে এই অভিজ্ঞতা রাজনৈতিক সংগঠন ও আন্দোলনে বিরাট ভূমিকা রাখে। ফলে সরকারগুলো যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সীমিত করে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করেছে, তখন সেটি উল্টো বুমেরাং হয়েছে।
কাঠমান্ডু বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জীবান শর্মা মনে করেন, নেপালের তরুণেরা বাংলাদেশের ও শ্রীলঙ্কার আন্দোলন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে এবং সেখান থেকে কৌশল শিখেছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পল স্ট্যানিল্যান্ড বলেন, এসব আন্দোলন একে অপরকে অনুপ্রাণিত করছে এবং ভবিষ্যতের জন্য এক ধরনের ডিজিটাল প্রতিবাদের কৌশল তৈরি করছে।
অন্যদিকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রুমেলা সেন মন্তব্য করেন, এই প্রজন্মের স্লোগানগুলো শুধু ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং ন্যায়বিচার, কর্মসংস্থান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তরিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
প্রশ্ন এখন একটাই—দক্ষিণ এশিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য কোন দেশ? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে দুর্নীতি প্রবল, সামাজিক বৈষম্য চরম, কর্মসংস্থান সীমিত এবং প্রবীণ নেতৃত্ব তরুণদের সঙ্গে সংযোগ হারিয়েছে, সেখানেই বিদ্রোহ ফেটে পড়তে পারে। পাকিস্তান, ভারত কিংবা অন্য কোনো দক্ষিণ এশীয় দেশ এই তরুণ বিদ্রোহের পরবর্তী কেন্দ্র হতে পারে বলেও অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় সৃষ্ট ‘জেন-জি বিপ্লব’ কেবল একক ঘটনা নয়, বরং একটি প্রজন্মের সামাজিক অস্বস্তি, ডিজিটাল সক্ষমতা ও ন্যায়বিচার চাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মিলিত অভিব্যক্তি।
পরবর্তী কোন দেশ বিপ্লবের পরিপূর্ণ পর্বের লক্ষ্য হবে তা নির্ধারণ করা কঠিন, কিন্তু যে দেশগুলোর সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বেশি, রাজনীতি মানুষের অধিকার ও মূল্যবোধের সাথে সরাসরি সংযুক্ত নয়, এবং যুব সমাজকে শুনে কোনও শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া গড়ে উঠছে — সেসব দেশ নিকট ভবিষ্যতে আন্দোলন দেখে যেতে পারে।