বান্দরবান স্বাস্থ্যসেবা বিপর্যয়: ৭ উপজেলা হাসপাতালে অর্ধেক জনবল
সদর হাসপাতালসহ জেলা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানের অভাবে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত; আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও কার্যকর হচ্ছে না।
অসীম রায় (অশ্বিনী): বান্দরবানের সাধারণ মানুষের চিকিৎসার একমাত্র ভরসাস্থল হলো সদর হাসপাতাল এবং জেলার সাতটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। কাগজে-কলমে ১০০ শয্যার সদর হাসপাতাল এখনো পরিচালিত হচ্ছে অর্ধেক জনবল দিয়ে। হাসপাতালের অবকাঠামো ও আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও জনবল সংকটে রোগীরা সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছেন না।
সাধারণ রোগীর দুর্ভোগ বাড়ছে
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে নিয়ম অনুযায়ী ২১ জন চিকিৎসক থাকার কথা, অথচ বর্তমানে মাত্র ১০ জন নিয়োজিত। নার্স ও স্টাফের ৬৮ পদের মধ্যে কাজ করছেন ৪০ জন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ৩৭ পদের মধ্যে আছেন মাত্র ১৮ জন এবং ২০টি চতুর্থ শ্রেণির পদের মধ্যে কাজ করছেন ১০ জন।
১৯৮৯ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে সদর হাসপাতাল যাত্রা শুরু করলেও ২০০৫ সালে শয্যা ১০০ করা হয়। কিন্তু নতুন শয্যা অনুযায়ী জনবল বৃদ্ধি না হওয়ায় হাসপাতাল কার্যক্রম এখন সংকটে। প্রতিদিন প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসেন। আধুনিক যন্ত্রপাতি যেমন আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিন, আইসিইউ থাকলেও টেকনিশিয়ানের অভাবে সেগুলো কার্যত অচল। ফলে রোগীরা বাধ্য হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হচ্ছে, যা অনেকের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়বহুল।
৭টি উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে। নায়ক্ষংছড়ি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দুপুরের পর পর্যন্ত উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা উপস্থিত থাকেন না। টিকিট কাউন্টারে রোগীর দীর্ঘ লাইন। কোলের শিশু নিয়ে বসে থাকা রোগীও ডাক্তার না পেয়ে নিরাশ হয়ে যাচ্ছেন। সদর হাসপাতালের মতো অন্যান্য উপজেলাতেও ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান অভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেবা বন্ধ রয়েছে।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, বান্দরবান সদর হাসপাতালই সাধারণ মানুষের একমাত্র আশ্রয়। পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান না থাকায় আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিশু রোগী মহিমা আক্তারের মা জানিয়েছেন, নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছেলে ছেলের জন্য চারটি টেস্ট করাতে হয়েছে বাইরে, শুধু কিছু ইনজেকশন ও ওষুধ হাসপাতাল থেকে পেয়েছেন। পৌরসভা ইসলামপুর এলাকার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, “দূরদূরান্ত থেকে রোগীরা এখানে আসে, কিন্তু ডাক্তার ও টেকনিশিয়ান না থাকায় চিকিৎসা পাওয়া যায় না। আল্ট্রা মেশিন ও আইসিইউ থাকলেও কার্যক্রম বন্ধ।”
সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. দিলীপ চৌধুরী জানিয়েছেন, ৫০ শয্যার জনবল নিয়েই ১০০ শয্যার হাসপাতাল চালানো হচ্ছে। চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ান সংকটের কারণে রোগীরা সঠিক সেবা পাচ্ছেন না। তিনি আরও জানিয়েছেন, আল্ট্রাসনোগ্রাফি মেশিনসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও টেকনিশিয়ানের অভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার চিঠি দেওয়া হয়েছে, তবে এখনও কোন পদক্ষেপ হয়নি।
২০১৬ সালের স্বাস্থ্য বুলেটিনে এই সংকট চিহ্নিত করা হয়েছিল। তখন সুপারিশ করা হয়েছিল, ১০০ শয্যা অনুযায়ী চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ান নিয়োগ বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ প্রদান ও ইনসেনটিভ ব্যবস্থা চালু করতে।
২০২৪ সালে সরকার ১০০ শয্যার হাসপাতালের জন্য ১৫৩ জন জনবল রাখার স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে বর্তমান সংকট অব্যাহত রয়েছে।
উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও মানবসম্পদ অভাবের কারণে সেবা বাধাপ্রাপ্ত। থাংচি, রুমা, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম ও নাইক্ষ্যংছড়ি হাসপাতালগুলোতেও চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানের সংখ্যা অনুমোদিত পদের অর্ধেকের বেশি নয়। অনেক রোগী বাধ্য হয়ে সদর হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকে যাচ্ছেন, যা সাধারণ মানুষের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক বোঝা সৃষ্টি করছে।
সার্বিকভাবে, বান্দরবান জেলার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এখন দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। ১০০ শয্যার সদর হাসপাতাল ও অন্যান্য উপজেলাগুলোর জন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স এবং টেকনিশিয়ান নিয়োগ, আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারযোগ্য করা এবং নিয়মিত মনিটরিং চালু করা সময়ের দাবি। নইলে সাধারণ রোগীরা সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন এবং প্রাইভেট খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করতে বাধ্য হবেন।