স্বপ্ন বনাম বাস্তবতা: হাসিনা আমলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ছবি: ৯ মে, ২০১৭ স্থান: সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

টুইট ডেস্ক: ২০১৭ সালের কথা। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। চোখে-মুখে স্বপ্ন, মনে আছে তখন, দেশের সেরা বিদ্যাপীঠে পড়ব—একদম অন্যরকম জীবন হবে। ভাবতাম, ঢাকায় থাকব, হলে উঠব, আর থাকবে আমার নিজস্ব রুম। স্বপ্নগুলো বড় ছিলো—নির্ধারিত বিছানা, একটি আলমারি, পড়াশোনার জন্য সুন্দর টেবিল-চেয়ার।

পড়ার সময় পড়ব, ঘুমের সময় ঘুমাব, আর বাকি সময়টা নিজের মতো করে জ্ঞানচর্চা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাজে ব্যয় করব।কিন্তু বাস্তবতা ছিলো একেবারেই আলাদা।

২০১৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে উঠি। সন্ধ্যায় আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বারান্দায়, পি জোনে। সেখানে আমাকে দেখানো হয় একটি সিঙ্গেল বেড, বলা হয় “এখানে শুয়ে যা, সাইড দিয়ে আরেকজন শুইবে।” রাত ১১:৩০ নাগাদ কয়েকজন এসে চিল্লা-পাল্লা শুরু করে—

“এই, এখানে কে রে! শুয়ে আছে! জানিস না, হল সেক্রেটারির জন্মদিন আজকে? দ্রুত নিচে নাম।”

নতুন হল কমিটি গঠিত হয়েছে মাত্র ১০–১৫ দিন, সবাই উত্তেজিত। পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বাঘা বাঘা পদ হাতিয়ে নিতে হবে। তখন আরেকজন বলে—

“আরে, এরা ফার্স্ট ইয়ার, আজকেই উঠছে।”

ঘুমঘুম চোখে হলে গেটে যাই, লাইনে দাঁড়াই, তালি দিই, গলা ফাটাই—
“শুভ শুভ শুভ দিন, ওমুক ভাইয়ের জন্মদিন! এস. এম. হলে পক্ষ থেকে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা।”

ধুমধাম করে কেক কাটা হয়, বক্সে গান বাজিয়ে নাচানাচি। আর আমি শুধু চোখ ঘুমে জ্বলে থাকা অনুভব করি। কখন কোথায় ঘুমিয়েছিলাম, মনে নেই।

পরের দিন, ৩১শে ডিসেম্বর, হল সভাপতির জন্মদিন। একই কাহিনি আবার! আবারও থার্টি ফার্স্ট নাইট। জানুয়ারি ১ থেকে ক্লাস শুরু হবে, আর আমরা সারা রাত না ঘুমিয়ে রাত কাটাই। সকালে ৮:০০ টার ক্লাস—প্রথম দুই দিনেই ভার্সিটিতে পড়ার স্বাদ ম্লান হয়ে যায়।

বারান্দার সিঙ্গেল বেডগুলোতে দুইজন! বেডগুলো একে অপরের সাথে লাগানো। পর্দার কোনো ব্যবস্থা নেই, বিদ্যুৎ লাইনের নিয়ম নেই। আমরা সবাই নিজের খরচে প্রথম পর্দা কিনে লাগাই। টিভি রুম থেকে মাল্টি দিয়ে বিদ্যুৎ লাইন টেনে সিঙ্গেল ছোট ফ্যান চালাতাম। মশারি টানার জায়গা নেই। সেই প্রিয় মশা! ভালোবাসার ছারপোকা!

দিশাহীন হয়ে আমি মাঝে মাঝে খোলা আকাশের নিচে ফ্লাইওভারে ঘুমাতাম। রাতে বৃষ্টি হলে ঘুম ভাঙতো, কাঁথা-বালিশ নিয়ে বারান্দায় বসে থাকতাম। কখনও হয়তো সেই মুহূর্তের ভিডিও করা হয়নি। ভোরে ঘুম ভাঙলেই ক্লাস ধরতে হবে। রাতে কে কোথায় শুয়েছিল, তা বোঝাও যেত না। ভোরে ঘুম ভাঙতেই দৃশ্যটা দেখে মনে হতো আমি হয়তো কোনো রিফিউজি ক্যাম্পে চলে এসেছি।

এটাই হলো স্বপ্ন। আর এটাই হলো স্বপ্নের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এই কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা বলল, হাজারো রাত স্ট্রাগল করতে হয় শুধুমাত্র এক রাত শান্তিতে ঘুমানোর জন্য।

ঢাকার সেই হল জীবন, যেখানে স্বপ্ন এবং বাস্তবতা দুইয়েরই খোলা জায়গা। যেখানে ছাত্রজীবনের আনন্দের সাথে জড়িয়ে আছে সংগ্রামের গল্প। আর এই স্মৃতিগুলোই পরে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায়ে পরিণত হয়।

লেখক: মোঃ তারেক মাসুম
স্সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সুত্র: সংগৃহীত, আমাদের সিলেট