জুবায়েরের বিরুদ্ধে তদন্ত দাবি: দুর্নীতির অভিযোগে সচিব বিদায়
দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড ছিলেন শিক্ষা সচিব জুবায়ের — সমালোচনার মুখে অপসারণের সিদ্ধান্ত
টুইট প্রতিবেদন: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জুবায়ের অবশেষে অপসারণের মুখে। একের পর এক অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে বিদ্যমান সরকার তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে বলে জানা গেছে।
হঠাৎ অপসারণের সিদ্ধান্ত
গতকাল (মঙ্গলবার) রাত ৯টার দিকে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম নিশ্চিত করেন, বিতর্কিত সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জুবায়েরকে অপসারণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।
মাইলস্টোন দুর্ঘটনার পর পরীক্ষার সিদ্ধান্তে তীব্র সমালোচনা
সোমবার (২১ জুলাই) রাজধানীর উত্তরা এলাকায় মাইলস্টোন স্কুলে একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। পরদিন এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিতের প্রস্তাব দিলে তা প্রথমে নাকচ করেন সচিব জুবায়ের। রাতেই ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনে। শেষমেশ রাত ২টায় পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম পরীক্ষা স্থগিতের ঘোষণা দেন।
পরদিন সচিবালয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা প্রবল আন্দোলন ও পুলিশি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে জুবায়েরের অপসারণের সিদ্ধান্ত আসে।
৩০০ কোটি টাকার কাগজ দুর্নীতি
গত শিক্ষাবর্ষে ৪০ কোটির বেশি বই ছাপানোর কাজে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সিদ্দিক জুবায়েরের বিরুদ্ধে। তিনি এনসিটিবির কর্মকর্তাদের ব্যবহার করে নির্দিষ্ট পেপার মিল থেকে বাধ্যতামূলকভাবে কাগজ কেনার নির্দেশ দেন। এ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হিসেবে বহিষ্কৃত এনসিপি নেতা সালাউদ্দিন তানভীর ও ৩৬ প্রেস মালিককে দুদক ইতিমধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু মূল হোতা জুবায়েরের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ পদক্ষেপ এতদিন নেওয়া হয়নি।
পদায়ন বাণিজ্যের অভিযোগ
জুবায়েরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কলেজে অধ্যক্ষ, উপাধ্যক্ষ ও কর্মকর্তাদের পদায়নের নামে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিতাড়িত যুগ্ম সচিব নুরুজ্জামানের নেতৃত্বে তিনি একটি বদলি সিন্ডিকেট গঠন করেছিলেন, যা আজও সক্রিয়। পদায়নের জন্য ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।
আইনি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পরীক্ষার স্থগিতাদেশে বাধা
আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটি জানায়, বোর্ডের নিজস্ব আইনি ক্ষমতা থাকলেও ‘কন্ট্রোলিং অথরিটি’ হিসেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মৌখিক সম্মতির প্রয়োজন হয়। এই সুযোগটিই ব্যবহার করেন সচিব জুবায়ের এবং শুরু করেন টালবাহানা।
বিতর্কিতদের রক্ষা ও দলের প্রতি পক্ষপাত
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট ‘জুলাই আন্দোলন’ বিরোধী মিছিলে অংশ নেওয়া কিছু কর্মকর্তাকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন জুবায়ের। মিছিলের সময় আওয়ামী লীগপন্থী স্লোগান দেওয়া হলেও তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তিমূলক পদক্ষেপ আটকে যায় সচিবের হস্তক্ষেপে। এছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের একের পর এক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষা প্রশাসনে পক্ষপাতিত্বের সংস্কৃতি চালু করেন।
শিক্ষা প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য
বিভিন্ন শিক্ষা প্রকল্পে স্মার্ট টিভির বদলে ইন্টারঅ্যাকটিভ প্যানেল কেনার নামে কোটি কোটি টাকার কমিশন নেওয়া হয়েছে সচিবের নেতৃত্বে। একাধিক প্রজেক্টে একই টেন্ডারদাতার বিজয় নিশ্চিত করতে তিনি ভূমিকা রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
কর্মকর্তাদের হয়রানি
অতীত ছাত্রদল বা ছাত্রশিবির সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যেই হয়রানির শিকার হতে হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি নিজের জেলার (নারায়ণগঞ্জ) কর্মকর্তাদের বিশেষ পদে বসিয়ে জুবায়ের একটি একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন।
জুবায়েরের বিরুদ্ধে এসব গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে তার বক্তব্য জানতে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সচিবালয়ে সরাসরি সাক্ষাৎ চেয়েও সাড়া মেলেনি।
দুর্নীতিতে জর্জরিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে সিদ্দিক জুবায়েরের অপসারণের সিদ্ধান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে প্রশাসন ও দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর কাছে এখন বড় প্রশ্ন—এই ‘দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড’-কে কবে আইনের আওতায় আনা হবে?