৩৯টি সেবায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক
টুইট ডেস্ক: চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে ৩৯ ধরনের সরকারি ও বেসরকারি সেবা পেতে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক নির্ধারিত এই নিয়মের আওতায়, সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র ছাড়া সেবা প্রদান করবেন না।
যদি কেউ প্রমাণপত্র ছাড়াই সেবা প্রদান করেন, তবে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। এই নিয়মটি টিআইএন ধারীদের রিটার্ন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে সরকারের একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।
এর আগে কয়েক বছর ধরে কিছু সেবার ক্ষেত্রে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক ছিল। তবে চলতি অর্থবছরে পূর্ববর্তী তালিকা থেকে ১৩টি সেবা বাদ দেওয়া হয়েছে। নিচে ২০২৫ সালের জন্য ৩৯টি সেবার তালিকা দেওয়া হলো, যেখানে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র প্রয়োজন।
আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র প্রয়োজনীয় সেবাসমূহের তালিকা-
১. ২০ লাখ টাকার বেশি ঋণ গ্রহণে।
২. কোনো কোম্পানির পরিচালক বা স্পনসর শেয়ারহোল্ডার হতে।
৩. আমদানি বা রপ্তানি নিবন্ধন সনদ গ্রহণ বা নবায়ন করতে।
৪. সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এলাকায় ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে।
৫. সাধারণ বিমার তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ার লাইসেন্স নবায়ন করতে।
৬. সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায় জমি, বিল্ডিং বা অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি, লিজ, হস্তান্তর, বায়নানামা বা আমমোক্তারনামা নিবন্ধন করতে।
৭. চিকিৎসক, দন্ত চিকিৎসক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্ট, চার্টার্ড সেক্রেটারি, কর আইনজীবী, একচুয়ারি, প্রকৌশলী, স্থপতি, সার্ভেয়ার হিসেবে স্বীকৃত পেশাজীবী সংস্থার সদস্যপদ নবায়ন করতে।
৮. মুসলিম ম্যারেজ অ্যান্ড ডিভোর্স (রেজিস্ট্রেশন) অ্যাক্ট, ১৯৭৪; হিন্দু বিবাহ নিবন্ধন আইন, ২০১২; বা স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট, ১৮৭২-এর অধীন রেজিস্ট্রার হিসেবে লাইসেন্স প্রাপ্তি বা নবায়ন করতে।
৯. ট্রেড বডি বা বাণিজ্যিক সংগঠনের সদস্যপদ গ্রহণ বা নবায়ন করতে।
১০. স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি বা কার্টিজ পেপারের ভেন্ডার বা দলিল লেখক হিসেবে লাইসেন্স নবায়নে।
১১. ড্রাগ লাইসেন্স, ফায়ার লাইসেন্স, পরিবেশ ছাড়পত্র, বিএসটিআই লাইসেন্স, বন্ডেড ওয়াটারহাউস লাইসেন্স, কাস্টমস এজেন্ট লাইসেন্স, ফ্রেট ফরওয়ার্ডিং লাইসেন্স বা বায়িং হাউস নিবন্ধন গ্রহণ বা নবায়নে।
১২. যেকোনো এলাকায় গ্যাসের বাণিজ্যিক ও শিল্প সংযোগ প্রাপ্তি বা বহাল রাখতে।
১৩. সিটি করপোরেশন এলাকায় আবাসিক গ্যাস সংযোগ প্রাপ্তিতে।
১৪. সিটি করপোরেশন বা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ প্রাপ্তিতে।
১৫. লঞ্চ, স্টিমার, মাছ ধরার ট্রলার, কার্গো, কোস্টার, ডাম্ব-বার্জসহ ভাড়ায় চালিত নৌযানের সার্ভে সার্টিফিকেট গ্রহণ বা নবায়নে।
১৬. পরিবেশ অধিদপ্তর বা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ইট উৎপাদনের অনুমতি গ্রহণ বা নবায়নে।
১৭. সিটি করপোরেশন, জেলা সদর বা পৌরসভায় অবস্থিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিশু বা পোষ্য ভর্তিতে।
১৮. কোম্পানির এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ গ্রহণ বা নবায়নে।
১৯. আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স গ্রহণ বা নবায়নে।
২০. আমদানির উদ্দেশ্যে ঋণপত্র খোলায়।
২১. ১০ লাখ টাকার বেশি মেয়াদি আমানত খোলা বা বহাল রাখতে।
২২. ১০ লাখ টাকার বেশি মূল্যের সঞ্চয়পত্র ক্রয়ে।
২৩. পৌরসভা, উপজেলা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন বা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে।
২৪. ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক বা উৎপাদন কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানকারী পদমর্যাদায় কর্মরত ব্যক্তির বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তিতে।
২৫. দশম গ্রেড বা তদূর্ধ্ব পদমর্যাদার সরকারি কর্মচারীর বেতন-ভাতাদি প্রাপ্তিতে।
২৬. স্বাভাবিক ব্যক্তি ব্যতীত অন্য করদাতাদের ক্ষেত্রে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, মোবাইল ব্যাংকিং বা ইলেকট্রনিক উপায়ে টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে কমিশন, ফি বা অন্যান্য অর্থ প্রাপ্তিতে।
২৭. কোনো নিবাসী করদাতা কর্তৃক অ্যাডভাইজরি, কনসালটেন্সি, ক্যাটারিং, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, জনবল সরবরাহ বা নিরাপত্তা সেবা সরবরাহ বাবদ কোম্পানি থেকে অর্থ প্রাপ্তিতে।
২৮. বিমা কোম্পানির এজেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণ বা নবায়নে।
২৯. দ্বিচক্র বা ত্রিচক্র মোটরযান ব্যতীত অন্য মোটরযানের নিবন্ধন, মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নকালে।
৩০. এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত এনজিও বা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার অনুকূলে বিদেশি অনুদানের অর্থ ছাড় করতে।
৩১. ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ই-কমার্স ব্যবসার জন্য লাইসেন্সিং অথরিটির কাছ থেকে লাইসেন্স নবায়নে।
৩২. কোম্পানি আইন, ১৯৯৪ বা সোসাইটিস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট, ১৮৬০-এর অধীন নিবন্ধিত ক্লাবের সদস্যপদ গ্রহণ বা নবায়নে।
৩৩. কোনো নিবাসী করদাতা কর্তৃক পণ্য সরবরাহ, চুক্তি সম্পাদন বা সেবা সরবরাহের উদ্দেশ্যে দরপত্র দলিলাদি দাখিলকালে।
৩৪. পণ্য আমদানি বা রপ্তানির উদ্দেশ্যে বিল অব এন্ট্রি দাখিলকালে।
৩৫. রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ), রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ), গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা অনুরূপ কর্তৃপক্ষ অথবা সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার নিকট ভবন নির্মাণের নকশা দাখিলকালে।
৩৬. সিটি করপোরেশন এলাকায় কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির নিকট বাড়ি ভাড়া বা লিজ প্রদানকালে।
৩৭. আয়কর আইনে নির্দিষ্ট ব্যক্তির নিকট পণ্য বা সেবা সরবরাহকালে।
৩৮. হোটেল, রেস্টুরেন্ট, মোটেল, কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স গ্রহণ বা নবায়নে।
৩৯. সামাজিক অনুষ্ঠান, করপোরেট প্রোগ্রাম, ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, প্রশিক্ষণ বা সমজাতীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য সিটি করপোরেশন এলাকায় কমিউনিটি সেন্টার, কনভেনশন হল বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে ভাড়া বা সেবা গ্রহণকালে।
আয়কর আইন, ২০২৩-এর ধারা ২৬৫(১) অনুসারে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দৃশ্যমান স্থানে প্রদর্শন করতে হবে। এই বিধান অমান্য করলে ধারা ২৬৫(২) অনুসারে ৫,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। এই নিয়মের পরিপালন নিয়মিত যাচাই করা হবে।
তবে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড একটি সাধারণ বা বিশেষ আদেশের মাধ্যমে যে কাউকে রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখানোর বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দিতে পারে।
আয়কর রিটার্ন সম্পর্কিত তথ্য
আয়কর রিটার্ন হলো করদাতার বার্ষিক আয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্ধারিত ফরমে দাখিল করতে হয়। এটি সাধারণত প্রতি বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে (করদিবস) দাখিল করতে হয়। রিটার্ন ফরম বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় পাওয়া যায় এবং এনবিআর-এর ওয়েবসাইট (www.nbr.gov.bd) থেকে বিনামূল্যে ডাউনলোড করা যায়।
আয়কর রিটার্ন ফরম পূরণের জন্য বিভিন্ন ধরনের ফরম রয়েছে, যেমন-
আইটি-১১ইউএমএ: বেতনভুক্ত করদাতাদের জন্য।
আইটি-১১সিএইচএ: ব্যবসা বা পেশা থেকে ৩ লাখ টাকার কম আয়ের জন্য।
আইটি-১১জিএ: ৩ লাখ টাকার বেশি আয়ের জন্য, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায়।
আইটি-১১জিএ-২০১৬: সকল ব্যক্তি করদাতার জন্য, তিন পৃষ্ঠার ফরম।
এই ফরমগুলোতে করদাতার পরিচিতি, আয়ের বিবরণ, কর পরিশোধের তথ্য এবং সম্পদ ও জীবনযাত্রার বিবরণী উল্লেখ করতে হয়। সময়মতো রিটার্ন দাখিল না করলে জরিমানা বা অতিরিক্ত কর আরোপ হতে পারে।
৩৯টি সেবায় আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলক করার এই উদ্যোগ সরকারের কর আদায় বৃদ্ধি এবং করদাতাদের নিয়ম মেনে চলার প্রতি উৎসাহিত করার একটি পদক্ষেপ।
এই তালিকার সেবাগুলো নিতে হলে করদাতাদের সময়মতো রিটার্ন দাখিল করা এবং প্রমাণপত্র সংরক্ষণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।