স্বপ্ন, সঞ্চয় ও স্টিয়ারিং: শখের শুরু ড্রাইভিং লাইসেন্সেই

বদিউল আলম লিংকন: ২০০৮ সাল। সদ্য একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরিতে ঢুকেছি। হেড অফিসে পোস্টিং। রাজধানী ঢাকার যানজট, গরমে হাঁসফাঁস, বাসে ঠেলাঠেলি, রিকশাওয়ালার হুঙ্কার—সব মিলিয়ে প্রতিদিন অফিসে যাওয়াই যেন যুদ্ধ।

এর মধ্যেই বুকের গভীরে জন্ম নিল এক সাধারন কিন্তু দামি স্বপ্ন—নিজের একটি গাড়ি থাকবে। সেটা নিয়ে অফিস যাব।

পরিকল্পনা করলাম, গাড়ি কেনার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। চাকুরী সবেমাত্র চার মাস, হটাৎ বেতন বাড়লো সবার। আমার বাড়ে ৪ হাজার টাক। মনে হলো এখনই সুযোগ। খুলে ফেললাম একটি ১০ বছরের ডিপিএস—”মিলেনিয়াম প্ল্যান”। প্রতিমাসে বেতনের কিছু অংশ রেখে দিতে লাগলাম।

মন বলতো, “দেখিস, ১০ বছর পর অফিস যাবি নিজের গাড়িতে। তখন কেউ আর বলবে না—‘ভাই, একটু সরেন।”

প্রথম স্বপ্নভঙ্গ

২০১৮ সালে ডিপিএস পূর্ণ হলো। হাতে পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত টাকাটা। মনে মনে ভাবলাম—এবার বুঝি স্বপ্ন পূরণের সময়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কিছু বলে। গাড়ির শোরুমে গিয়ে দেখি, ২০০৮ সালে যে টাকায় একটি মাঝারি মানের নতুন/রিকন্ডিশন গাড়ি মিলতো, এখন সেই টাকায় ভালো একটি পুরাতন গাড়িও পাওয়া যায় না। স্বপ্নটা তখনও রয়ে গেল—আধখানা।

দ্বিতীয় প্রচেষ্টা

স্বপ্ন ভাঙলো, কিন্তু স্বপ্ন দেখা থামলো না। আরও একবার সিদ্ধান্ত নিলাম—আরও ৫ বছরের জন্য নতুন একটি ডিপিএস করবো। এইবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আর অপেক্ষা নয়। টাকাটা রাখলাম সঞ্চয়পত্রে। আমার আবেগ ও শখের কথা অনেকের কাছে ইতিমধ্যে পৌছে গেছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুরা কেউ কেউ বললেন, “বিয়েশাদি করে সংসার করো আগে, গাড়ি তো পরে কিনতে পারবে।” কিন্তু মন বললো, “এইটা আমার স্বপ্ন, কেউ বুঝুক বা না বুঝুক।” আমার স্বপ্ন শুনে আম্মা একদিন বলে বসলো, বাবা গাড়ি যদি কিনতে পারিস, নতুন/রিকন্ডিশন গাড়ি কিনবি। পুরাতন গাড়ি না।

বলা বাহুল্য, যে কথা সেই কাজ। শখ করে বাবা-মাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে গেলাম, আর সেখানেই বিয়ে হয়ে গেল।

পাঁচ বছর পর, ২০২৩ সালে সেই ডিপিএসও পূর্ণ হলো। কিন্তু ইতিহাস যেন নিজেকে আবারও আবৃত্ত করলো—গাড়ির দাম আগের চেয়ে আরও বেড়ে গেছে। প্রযুক্তি, ডিজাইন, ফিচার—সবই নতুন, কিন্তু আমার সেই পুরোনো হতাশাটা ঠিক একই রকম রয়ে গেল। ইতিমধ্যে সঞ্চয়পত্রের টাকাসহ তা বেড়ে দাঁড়ালো প্রায় ২০ লাখে।

স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘাত

সময় যায়, বছর ঘুরে যায়, কিন্তু গাড়ি কেনার সাহস আর হয় না। মাঝেমধ্যে শোরুমে যাই, গাড়ি দেখি, ফেরত চলে আসি। শোরুমের কর্মীরা বুঝে নেয়—আমি ‘সিরিয়াস’ ক্রেতা নই। মধ্যবিত্ত টান পোশাকে-চেহারায় লেগে থাকে—সেটা তারা বুঝে ফেলে।

তারা কেউ কেউ এমনভাবে কথা বলে যেন আমি শুধু দাম জিজ্ঞেস করতেই এসেছি, গাড়ি কেনার সাধ্য বা সাহস আমার নেই। অথচ তারা জানে না, আমার সেই ১৬ বছরের সঞ্চয়, লজ্জা, আশা-নিরাশার গল্প।

গ্রামে গেলে প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজনরা দেখে—ব্যাংকে চাকরি করি, শহরে থাকি, দুই সন্তানের বাবা—তারা ধরে নেয়, আমি নিশ্চয়ই ধনী। বলে বসে “তোমার তো নিশ্চয়ই গাড়ি আছে?”—প্রশ্ন আসে, আর আমি মুখে হাসি টেনে বলি—“আলহামদুলিল্লাহ, মোটরসাইকেল আছে।”

তারা জানে না, সেটাও বিয়েতে ভাইরা ভাইয়ের কাছ থেকে গিফ্ট পাওয়া মোটরসাইকেল, আর সেটা চালাতেও আমার ভয় লাগে—সড়ক দুর্ঘটনার আতঙ্কে।

শেখার শুরু, আত্মবিশ্বাসের উত্থান

একদিন ভাবলাম, না বুঝে থাকলে বুঝে নিতে হবে। শুরু করলাম ইউটিউবে গাড়ি নিয়ে পড়াশোনা। বুঝতে শিখলাম অকশন শিট, শিখলাম “গ্রেড A”, “B”, “R”, “S” কী বোঝায়। কোনটা রিকন্ডিশন, কোনটা এক্সিডেন্টাল, কোনটা ভালো মেইনটেইনড—সবই জানার চেষ্টা করলাম, আরো সময় পেরিয়ে গেল ২ মাস।

জ্ঞান অর্জনের এই যাত্রায় একটা আনন্দ খুঁজে পেলাম। মনে হলো, যেন আবার ছাত্রজীবনে ফিরে গেছি। ধীরে ধীরে গড়ে উঠলো আত্মবিশ্বাস—আমি পারবো, আমি বুঝে শুনে গাড়ি কিনবো।

শখের শুরু ড্রাইভিং লাইসেন্সেই

যখন প্রথম গাড়ির স্বপ্ন দেখেছিলাম, তখন শুধু চিন্তায় সীমাবদ্ধ থাকিনি—প্রথম পদক্ষেপ ছিল ড্রাইভিং লাইসেন্স করা। শখের বশে চালানো শিখেছিলাম, আর সেই শখকে বাস্তবের পথে চালিত করতে নিয়ম মেনে লাইসেন্সও করেছিলাম। যদিও এরপর অনেক বছর কেটে গেছে, লাইসেন্সের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।

তবুও আশা ছাড়িনি

গাড়ির স্বপ্ন যেমন ছিল দীর্ঘমেয়াদী, ঠিক তেমনি লাইসেন্স নিয়েও ছিল আমার নতুন করে পরিকল্পনা। তাই আবার উদ্যোগ নিলাম। এবার করলাম ১০ বছরের জন্য ডিজিটাল ড্রাইভিং লাইসেন্স—এক নতুন প্রত্যয়ের সঙ্গে।

ভাবলাম, শুধু গাড়ি কিনলেই তো হবে না, চালানোর অধিকার ও যোগ্যতাটাও থাকা চাই—সঠিকভাবে, নিরাপদে। কারণ এই গাড়ি শুধু স্বপ্নপূরণের বাহন নয়, এটি আমার প্রিয়জনদেরও যাত্রাসঙ্গী।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ও সাহসী পদক্ষেপ

এমন সময় চোখ আটকে গেল একটি গাড়িতে—Toyota Noah, ২০১৯ মডেল, জি প্যাকেজ, গ্রেড-বি, ব্রোঞ্জ কালার, চেহারায় পরিপাটি, স্পেসিওয়াস, পরিবারের জন্য আদর্শ। দাম ৩৫-৩৮ লাখ টাকা পড়বে। আর আমার হাতে তখন মাত্র ২০ লাখ টাকা।

মন বললো, “বাকি টাকা কীভাবে জোগাড় করবি? আবার কি স্বপ্ন ভেঙে যাবে?” একান্ত মনের মানুষটাকে আমার স্বপ্নের কথা শেয়ার করলাম, কিন্তু তাতে লাভ হলো না। সেখানেও হতাশার বাণী শুনতে হলো।

না, এবার পিছু হটার নয়। এমটিবি হতে নিলাম ২০ লাখ টাকার একটি ব্যক্তিগত ঋণ। হিসাব-নিকাশ মিলিয়ে, কিস্তির ভার বহন করে গাড়িটি কিনে ফেললাম।

সেই দিনের সকাল

গাড়ির বাইনা দেওয়া হয়েছে। ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে গাড়িটি দেখতে গেলাম। কিন্তু তাদের বলা হয়নি, আজই গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরবো। একজন ড্রাইভাকে সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। কারন আমি নিজেতো তখনও ড্রাইভিং পারি না।

আমদানিকারকের গ্যারেজে গিয়ে দেখি, কয়েকটি গাড়ির মধ্যে একটি গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। সবাই তাকিয়ে—“এইটা আমাদেরটা হবে কিনা?” ছেলে বললো, “এই গাড়িটা হলে দারুণ হতো।” আমার চোখও আটকে গেলো সেই গাড়িতে। মনে মনে ভাবলাম—‘এইটাই যদি হয়, তবে তো স্বপ্ন যেন কল্পনার সঙ্গে মিলে যায়।’

আমদানিকারক এসে বললেন, “এইটাই আপনার গাড়ি।” আমরা হতবাক! অন্যরকম এক অনুভূতি। ছেলে-মেয়ের মুখে উজ্জ্বল হাসি, স্ত্রীর চোখে আনন্দের ঝিলিক। আমি তখনো বিশ্বাস করতে পারছি না—এই এত সুন্দর গাড়ির মালিক আমি!

বিদায় ও নতুন অধ্যায়

২০২৪ সালের প্রায় শেষ হতে চলেছে। গাড়িটি বাসায় আসলো। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম। ২০০৮ সালের সেই আমি—ঘামে ভেজা শার্টে অফিসে ছুটে চলা আমি—আজ স্টিয়ারিং-এ হাত রাখছে, রাখবে।

কিন্তু জীবনের এক নির্মম সত্য তখনও অপেক্ষায়। চাকরির বদলি হয়ে গেছে। পরদিনই রাজধানী ছেড়ে চলে যেতে হবে ২০০ কিমি দূরে। স্ত্রী-সন্তানদের ফেলে, গাড়িটি নিয়ে ড্রাইভারকে নিয়ে যাত্রা করলাম নতুন কর্মস্থলে। আনন্দের মুহূর্তে ঢুকে পড়লো হৃদয় বিদারক বিষাদ।

গাড়িটা শুধু গাড়ি নয়

এই গাড়িটি শুধু একটা যন্ত্র নয়—এটা আমার ১৬ বছরের স্বপ্ন, সঞ্চয়, ধৈর্য, লজ্জা, আত্মমর্যাদা আর আত্মবিশ্বাসের ফলাফল।

আজ যখন গাড়ি চালিয়ে সন্তানদের স্কুলে নামিয়ে দিই, স্ত্রীকে বাজারে নিয়ে যাই, কিংবা অফিসে পৌঁছাই—একটা ছোট্ট গর্ব অনুভব করি। বিলাসিতা থেকে নয়, বরং জানি—এই অর্জনের পেছনে লেগে আছে অজস্র রাতের চিন্তা, অসংখ্য দিনের হিসাব, না বলা কষ্ট।

এই গল্পটা কেবল একটি গাড়ি কেনার গল্প নয়। এটি একজন মানুষের স্বপ্ন দেখা, সেই স্বপ্নের পেছনে লেগে থাকা, প্রতিকূলতা সহ্য করা, নিজের সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে তার ভিতরে থেকেই সেরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার গল্প। আর সবচেয়ে বড় কথা—এই গল্পটা বলে দেয়, ‘মধ্যবিত্ত’ মানেই শুধু সীমাবদ্ধতা নয়; বরং সীমাবদ্ধতার মাঝেই অসীম স্বপ্ন বেঁচে থাকে।

স্টিয়ারিং ধরার মুহূর্তে আমি আর শুধু গাড়ি চালাই না—আমি চালাই আমার জীবন, আমার আত্মবিশ্বাস, আর সেই স্বপ্নটাকে… যা ভাঙতে ভাঙতে শেষ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে।