ভেনেজুয়েলান অভিবাসীরা স্যালভাদরের বিতর্কিত কারাগারে: মানবাধিকার নিয়ে জোর বিতর্ক
বিশ্ব ডেস্ক: অভিবাসীদের সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনার মুখে পড়েছে এল সালভাদর। যুক্তরাষ্ট্রের বিতাড়িত শত শত ভেনেজুয়েলান নাগরিককে বিচার ছাড়াই স্যালভাদরের বিতর্কিত ও কুখ্যাত ‘সেন্ট্রো দে কনফিনামিয়েন্তো দেল তেরররিসমো’ বা সংক্ষেপে সিইসিওটি (CECOT) কারাগারে আটকে রাখায় এ বিতর্কের জন্ম হয়েছে।
বিতাড়নের পেছনের ঘটনা
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর এল সালভাদর সফরের সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট নাইব বুকেলে প্রস্তাব দেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত অপরাধীদের তার দেশের বৃহৎ কারাগারে রাখা যেতে পারে। এরই ধারাবাহিকতায় ট্রাম্প প্রশাসন ১৫ মার্চ ২৬১ জনকে বিতাড়িত করে, যাদের মধ্যে ১৩৭ জনকে ১৭৯৮ সালের বিতর্কিত এলিয়েন এনিমিজ অ্যাক্ট এর আওতায় বিতাড়নের কথা জানানো হয়।
যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, এসব ব্যক্তি ভেনেজুয়েলার কুখ্যাত “ট্রেন দে অ্যারাগুয়া” গ্যাংয়ের সদস্য। যদিও তাদের অপরাধসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তার দেওয়া আদালতের নথি অনুযায়ী, অনেকের বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের রেকর্ড না থাকলেও তাদের ‘জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বন্দিদের স্থান সিইসিওটি
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চালু হওয়া সিইসিওটি কারাগারটিকে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় ও কঠোর নিরাপত্তার কারাগার হিসেবে ঘোষণা করে এল সালভাদর। রাজধানী সান সালভাদর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে ৫৭ একর জায়গাজুড়ে গড়ে উঠা এই কারাগারে ধারণক্ষমতা ৪০ হাজার। নির্মাণ ব্যয়ে ব্যয় হয় প্রায় ১১৫ মিলিয়ন ডলার।
বর্তমানে কারাগারটিতে বন্দিদের সংখ্যা সরকারি হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৪,৫০০ জন হলেও সাম্প্রতিক সময়ে সঠিক সংখ্যা প্রকাশ করা হয়নি নিরাপত্তাজনিত কারণে।
বন্দিদের জীবনযাপন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি
কারাগারের অভ্যন্তরের পরিবেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর উদ্বেগ গভীর। বন্দিরা গাদাগাদি করে, ন্যাড়া মাথা ও শুধুমাত্র শর্টস পরে অবস্থান করছে – এমন ছবি ও ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি নেই, নেই বিনোদন বা পুনর্বাসনের কোনও ব্যবস্থা।
ইন্টার-আমেরিকান কমিশন অন হিউম্যান রাইটস ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে জানায়, প্রতি বন্দির জন্য মাত্র ৬.৪৫ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অনেক নিচে। জরুরি অবস্থার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬,০০০-এর বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে বেআইনি আটক, নির্যাতন এবং ৩৬৬টি মৃত্যুর মতো ভয়াবহ ঘটনা।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
সিইসিওটি কারাগার নিয়ে বিশ্বজুড়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একদিকে, আর্জেন্টিনার নিরাপত্তামন্ত্রী প্যাট্রিসিয়া বুলরিচের মতো ব্যক্তিরা এটিকে অপরাধ দমনের আদর্শ মডেল হিসেবে দেখছেন। অপরদিকে, মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, বিচারবহির্ভূত আটক ও নির্যাতনের এই ব্যবস্থাকে কোনোভাবেই সমর্থন করা যায় না।
এমনকি ইউটিউবের কিছু জনপ্রিয় কনটেন্ট ক্রিয়েটরও তাদের ভিডিওতে এই কারাগারের ভয়ংকর পরিবেশ তুলে ধরেছেন, যা মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।
বিতর্কিত ভবিষ্যৎ
স্যালভাদরের প্রেসিডেন্ট নাইব বুকেলে ঘোষণা দিয়েছেন, গ্যাং সদস্যদের বাকি জীবন সিইসিওটি কারাগারেই কাটাতে হবে। বিচারমন্ত্রী গুস্তাভো ভিলাতোরো আরও স্পষ্ট করে বলেন, “একবার যারা এই কারাগারে ঢুকবে, তারা আর কখনো বের হতে পারবে না।”
এতকিছুর মধ্যেও প্রশ্ন থেকে যায় – বিচারহীন আটক এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই সংস্কৃতি কতটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে একটি গণতান্ত্রিক বিশ্বে?
এবং ভেনেজুয়েলান অভিবাসীদের অপরাধ প্রমাণ ছাড়াই এমন নিষ্ঠুর ব্যবস্থার মুখোমুখি করা কি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির লঙ্ঘন নয়?