সুদের হার ও ডলার বাজারে হস্তক্ষেপে আপত্তি আইএমএফের

টুইট ডেস্ক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংস্কারের অগ্রগতিতে একদিকে সন্তোষ প্রকাশ করলেও, বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক সূচকে দুর্বলতা ও দ্ব্যর্থতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বিশেষ করে কর-জিডিপি অনুপাতের নিম্ন হার, নীতিনির্ধারিত সুদের হারের কাঠামো এবং বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি হস্তক্ষেপ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে সংস্থাটি।

রোববার (৬ এপ্রিল) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, ডেপুটি গভর্নর এবং নির্বাহী পরিচালকগণের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করে ঢাকায় সফররত আইএমএফ প্রতিনিধিদল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

কর-জিডিপি অনুপাত নিয়ে উদ্বেগ

বাংলাদেশে কর-জিডিপি রেশিও বর্তমানে মাত্র ৭.৫ শতাংশ, যেখানে প্রতিবেশী নেপালে এই হার ১২-১৩ শতাংশ এবং ভারতে ১৭-১৮ শতাংশ। আইএমএফ মনে করে, বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির জন্য এ হার অত্যন্ত নিচু এবং কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন অর্জনে এটি বড় বাধা। তারা স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, রাজস্ব আয়ের পরিধি না বাড়ালে সরকার ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অর্থায়ন দীর্ঘমেয়াদে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা কর আদায়ে ইতিবাচক মানসিকতা দেখিয়েছি। লাখ লাখ করদাতা এখনো শূন্য রিটার্ন দেন—তাদের অন্তর্ভুক্ত করা এবং কর কাঠামোর সংস্কারে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”

সুদের হার ও মুদ্রানীতি

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, যা নিয়ে সংস্থাটির আপত্তি রয়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা—বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির উচ্চচাপ অব্যাহত থাকায় সুদের হার কমানোর সুযোগ আপাতত নেই। বরং আইএমএফের বক্তব্য—মূল্যস্ফীতি ও বিনিয়োগের ভারসাম্য রক্ষায় আরও কার্যকর, বাজারচালিত সুদনীতির প্রয়োজন রয়েছে।

মুদ্রাবাজার ও রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা

বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি হস্তক্ষেপ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে আইএমএফ। তারা বলেছে, ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে বাজারের ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ ও লচনিক্সভিত্তিক (rule-based) পদ্ধতির দিকে যাওয়ার সুপারিশ করেছে তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা বর্তমানে বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে কিছু হস্তক্ষেপ করছি, তবে ভবিষ্যতে ধাপে ধাপে বাজারমুখী বিনিময় হার কাঠামো গড়ে তোলা হবে।”

খেলাপি ঋণ ও ব্যাংক সংস্কার

খেলাপি ঋণ কমানো, ব্যাংক খাতে স্বচ্ছতা আনা এবং ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন—এসব নিয়েও আইএমএফ জানতে চেয়েছে। তারা জানতে চেয়েছে, ঋণ সংশোধন ও রেজ্যুলেশন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কী পদক্ষেপ নিয়েছে।

ভ্যাট ও রাজস্ব আদায়ের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে ভ্যাট সিঙ্গেল রেট চালুর প্রস্তাবও আলোচনায় আসে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “ভ্যাট একক হারে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, তবে এটি একবারে সম্ভব নয়। পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরি হচ্ছে।”
ঋণের কিস্তি ছাড়ে শর্তাবলি পর্যালোচনা

আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণের তৃতীয় কিস্তি ছাড়ে আগ্রহী হলেও, শর্তাবলির বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করছে। রাজস্ব আদায়, বাজেট ঘাটতির সীমারেখা, সুদের হার নীতিমালা ও ডলারের বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা—এসব বিষয়ই কিস্তি ছাড়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।

অর্থ উপদেষ্টা জানান, “আইএমএফ এখন রিভিউ করবে—আমরা কীভাবে ট্যাক্স-জিডিপি বাড়াব, বাজেট ঘাটতি কীভাবে কমাব। এরপর তারা সিদ্ধান্ত নেবে পরবর্তী অর্থ ছাড়বে কি না।”

আইএমএফের আশ্বাস ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশের আর্থিক খাত সংস্কারে ইতিবাচক অগ্রগতি ও সদিচ্ছার প্রশংসা করেছে আইএমএফ। তারা জানিয়েছে, যেকোনো প্রয়োজনে তারা কারিগরি ও নীতিগত সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, “আমরা আর্থিক খাত সংস্কারে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আইএমএফ আমাদের সংস্কার পরিকল্পনার প্রশংসা করেছে। পরবর্তী বৈঠকের পর আরও বিস্তারিত জানানো হবে।”