‘জুনের মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা যেতে পারে’

টুইট ডেস্ক : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেশে কার্যত কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান নেই। এ মুহূর্তে সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব। আগামী জুনের মধ্যে সব সমতল ও পাহাড়ের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।

শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) স্থানীয় সংস্কার কমিশনের প্রকাশিত প্রাথমিক রিপোর্টের সুপারিশে এসব কথা বলা হয়।

সুপারিশে বলা হয়, বর্তমানে নতুন একটি স্বচ্ছ ক্যানভাসে নতুন ছবি আঁকা সম্ভব। নতুবা নির্বাচনের পূর্বে অনেক প্রতিষ্ঠানের মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে আইনি জটিলতার উদ্ভব হতে পারে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সংসদীয় পদ্ধতি চালু করার আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে জনপরিসরে থাকলেও কোনো সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এখন সে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

আগামী মার্চ/এপ্রিল ২০২৫ এর মধ্যে একটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে ৫টি প্রতিষ্ঠানের জন্য দুটি একীভূত স্থানীয় সরকার আইন প্রণয়ন করে আগামী জুন, ২০২৫ এর মধ্যে সব সমতল ও পাহাড়ের ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যেতে পারে।

প্রস্তাবিত ‘স্থানীয় সরকার কমিশন’ এ বিষয়ে বিস্তারিত কাজ এপ্রিল এর আগে সমাপ্ত করতে পারে। তবে জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে সরকার, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং নির্বাচন কমিশনের মধ্যে একটি ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হলেই তা সম্ভবপর হবে।

এতে আরও বলা হয়, পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদ আইনকে সংসদীয় কাঠামোতে সংস্থাপিত করে আইন সংশোধন করে জুন, ২০২৫ এর মধ্যে পাহাড়ের তিনটি জেলা পরিষদের নির্বাচনও সমাপ্ত হতে পারে।

রিপোর্টে বলা হয়, প্রতিটি ইউনিয়নে ন্যূনতম ৯টি ওয়ার্ড এবং সর্বাধিক ৩০টি ওয়ার্ড হতে পারে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ওয়ার্ড সংখ্যা নির্ধারিত হবে। প্রতিটি উপজেলা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের জন্য তিনটি ওয়ার্ডে বিভক্ত হবে। আর প্রতিটি ইউনিয়ন উপজেলার তিন থেকে পাঁচটি ওয়ার্ডে বিভক্ত হবে।

ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলার কোনো ওয়ার্ডের কোনো প্রশাসনিক ও নির্বাহী দায়িত্ব থাকবে না। ওয়ার্ড সদস্যগণ নিজ নিজ পরিষদ ও কাউন্সিলে বিধানিক দায়িত্ব পালন করবেন। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের সাধারণ সদস্য নির্বাচনে সরকারি বেসরকারি যেকোনো কর্মচারী কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে স্ব পদে থেকেও নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।

তবে চাকরিরত কোনো সদস্য নির্বাচিত হলে পরিষদের সার্বক্ষণিক কোনো পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। তিনি সাধারণ সভা বা অধিবেশন ও স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসাবেই শুধু দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।

‌‌‘প্রস্তাবিত নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণার জন্য নিচের চিত্রসমূহ দেখা যেতে পারে। একই তফসিলে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা এবং সিটি কর্পোরেশন অংশগ্রহণ করবে।

প্রতিজন ভোটার নিজ নিজ ইউনিয়ন, পৌরসভা ও সিটির ওয়ার্ডের জন্য একটি ব্যালট পেপার, উপজেলার জন্য একটি এবং জেলার জন্য একটি ব্যালট পেপার পাবেন। তিনটি ব্যালটে তিনটি বা (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) একাধিক ভোট দিয়ে তাদের ভোট শেষ করবেন।’

সুপারিশে বলা হয়, ১৯৭২ সালের পর ৫টি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য পারস্পরিক সম্পর্কবিহীন যে ৫টি পৃথক আইন ও অসংখ্য বিধিমালা বিভিন্ন সময় জারি করা হয়েছে। সে সব আইন ও বিধিসমূহ বাতিল করে সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপুর্ণ দুইটি একীভূত ও একক স্থানীয় সরকার আইন ও প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন করে সব পরিষদ সমূহের মধ্যে আন্ত:প্রতিষ্ঠান সম্পর্ক ও সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

এরকম দুইটি আইন করা হলে ঐ আইন বলে পাঁচটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো হবে একই ধাঁচের সংসদীয় পদ্ধতির। তখন নির্বাচন ব্যবস্থাটিও হবে সহজ, ব্যয় ও সময় সাশ্রয়ী।

সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে প্রতি তিন আসনের মধ্যে একজন সংরক্ষিত নারী সদস্য নির্বাচনের পরিবর্তে প্রতি নির্বাচনে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে পুরো পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়। তিনটি নির্বাচন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন হওয়ার পর চতুর্থ নির্বাচনে সংরক্ষণ পদ্ধতি বিলোপ করে সবার জন্য সব আসন উন্মুক্ত হয়ে যেতে পারে। তখন থেকে নারী-পুরুষ সবাই সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচন করার সুপারিশ করা হলো।

প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষিত নারী আসনসমূহ ঘূর্ণায়মান (রোটেশনাল) পদ্ধতিতে ওয়ার্ড সংরক্ষণ করে পূরণ করা যেতে পারে। এতে করে সংগঠনে দ্বৈততা পরিত্যক্ত হবে। নারীগণ একটি নিজস্ব আসনে প্রতিনিধিত্ব করে শাসনব্যবস্থা ও উন্নয়নে কার্যকরভাবে অংশ নিতে পারবেন।

গ্রাম ও নগরের সর্বত্র সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কাঠামো হবে সমরূপ। স্থানীয় সরকারের “স্থানীয় সরকার সার্ভিস” নামক একটি নিজস্ব সার্ভিস কাঠামো থাকবে। সে সার্ভিসের অধীন জনবলের ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী পদায়নের সুযোগ থাকবে। কর্মচারীদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত অভিগম্যতা থাকলে পদোন্নতি ও পদায়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

স্থানীয় সরকারের জন্য জাতীয় সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন ছাড়াও জাতীয় সরকারের অর্থ প্রাপ্তির পরিমাণ সম্পর্কিত একটি গ্যারান্টি ক্লজ থাকলে স্থানীয় সরকারের আগাম উন্নয়ন পরিকল্পনা করা সহজতর হয়। পার্বত্য অঞ্চলে ভোটার তালিকার ওপর একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অন্য একদিনে পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন সম্পন্ন হতে পারে। একটি একক তফসিলে জাতীয় নির্বাচনের জন্য তৈরিকৃত ভোটার তালিকায় সম্ভাব্য ২০২৫ এ জাতীয় নির্বাচনের আগে বা যখন সরকার, নির্বাচন কমিশন ও অংশীজনরা চান তখনই স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

সংবিধানের স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত বিধানসমূহের পুনঃপর্যালোচনা দরকার এবং এখানে স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে প্রথমে তিনটি সুপারিশ করা যেতে পারে। সংবিধানের তৃতীয় পরিচ্ছেদের সব ‘স্থানীয় শাসন’ শব্দাবলির স্থলে ‘স্থানীয় সরকার’ প্রতিস্থাপিত হবে। স্থানীয় সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত শব্দ বা প্রত্যয়।

অনুবাদ করতে গিয়ে স্থানীয় সরকারে মূল ধারণা বিকৃত হয়ে পড়েছে। তাই স্থানীয় সরকার সংবিধানে সংস্থাপিত হওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনসহ সব ক্ষেত্রে ‘সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন’ এ ধারাটির এ অংশ সংশোধন করে সংবিধানে সকল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জন্য জন্য উপযোগী একটি কার্যশীল সাংগঠনিক কাঠামো নির্ধারণ করে দিতে পারে। যা জাতীয় সরকার ও দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

সে কাঠামোর সুরক্ষায় প্রতিশ্রুতি যুক্ত থাকতে পারে। সে কাঠামোটি হতে পারে দেশের সব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ জাতীয় সরকারের মতো রাষ্ট্রপতি সরকারের আদলের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির প্রতিরূপ। বিরাজিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহ বর্তমানে চেয়ারম্যান ও মেয়র সর্বস্ব এবং রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থার মতো করেই কাজ করে। এখানে পরিষদ অচল থাকে, এক ব্যক্তির একক এক ধরনের স্বৈরশাসন বলবৎ হয়।

সংবিধানের ১১৯ (১) অনুচ্ছেদে একটি নতুন লাইন যুক্ত করা যেতে পারে ‘নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে স্থানীয় পরিষদের নির্বাচন সমূহ পরিচালনা করবে’ এটি হলে নির্বাচন কমিশন সরকারের অনুরোধের অপেক্ষা না করে নিজেরা স্বাধীনভাবে স্থানীয় নির্বাচনের সকল তফসিল সময়মতো নির্ধারণ করতে সাংবিধানিকভাবে সক্ষম হবে। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতীক (দলীয় প্রতীক) ব্যবহার করা যাবে না।