হাসিনার পতনে বাংলাদেশের নবযাত্রা

সম্পাদকীয়: আজ, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ছয় মাস পূর্ণ হলো। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল, যা কেবল দেশ নয়, সারা পৃথিবীকে অবাক করেছে।

ছবি সংগৃহীত

প্রায় দেড় দশকের শাসনযুগে পরাধীনতা ও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সামনে সরকারকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পদত্যাগ করতে হয়। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যার অভিঘাত এখনও বাংলাদেশবাসীর মনের মধ্যে তাজা।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হামলায় আবু সাঈদ মুগ্ধ ওয়াসিমসহ ১ হাজারেরও বেশি মানুষ শহিদ হয়েছেন। তাণ্ডবে ৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, ২৩ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন এবং অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। এখনো বহু মানুষ শরীরে বুলেটের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

শেখ হাসিনার সরকারের পতন ছিল দীর্ঘদিনের অব্যাহত নির্যাতন ও দমন-পীড়নের এক ফলস্বরূপ। বিশেষত সরকারি চাকরি কোটা সংস্কার, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গুম, হত্যা ও নির্যাতন জনবিরোধী শাসন ব্যবস্থার আঁকড়ে থাকা অবস্থায় সরকারের পতন এক অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

শাসকের নৃশংসতা, দলীয় সন্ত্রাস এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত ব্যবহার জনগণের ক্ষোভকে আগুনে পরিণত করে। শেখ হাসিনার সরকারের প্রতিশোধমূলক কর্মকাণ্ড এবং জঘন্য অপরাধের দায়ে এখন তাদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা চলছে, এবং বিচার শুরু হয়েছে।

জনগণের এককথায় চাওয়া ছিল ‘স্বৈরাচারের পতন’। ছাত্র আন্দোলন যে একদফা দাবি নিয়ে রাজপথে নেমেছিল, তা আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার ও তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। প্রায় দুই শতাধিক হত্যামামলা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান দেশব্যাপী চলছে। শাসক দলের অনেক নেতা বিদেশে পালিয়ে গেছেন, আর যারা দেশেই রয়েছেন, তারা গ্রেফতারের শঙ্কায় আত্মগোপন করেছেন।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে প্রাথমিক সংস্কার কাজগুলো শুরু হয়েছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত, নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারী চাকরিতে কোটা সংস্কার থেকে শুরু করে বিচারবহির্ভূত হত্যা, অবাধ বাকস্বাধীনতা, সরকারের দুর্নীতি এবং জনগণের প্রতি অঙ্গীকারহীনতা-সবগুলো বিষয়ই ছিল দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গভীর ক্ষত।

আজকের বাংলাদেশ যেন এক নতুন দিন শুরু করছে। তবে, সরকারের পতনের পরেও যারা এর সাথে জড়িত ছিলেন, তাদের বিচার করা এবং দেশকে বৈষম্যমুক্ত এবং দমন-পীড়নহীন একটি ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নেওয়া এক কঠিন কাজ। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন, মানবাধিকারের প্রতি প্রতিশ্রুতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য নতুন পথে চলতে হবে।

শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছে, তা ভবিষ্যতে দীর্ঘকাল ধরে আলোচিত হবে। জনগণের অধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতার জন্য এই সংগ্রাম সবার জন্য শিক্ষা হতে পারে যে, জনগণের শক্তি কখনোই নিঃশেষিত হয় না।

তবে, এখন নতুন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দেশের মানুষের আস্থা ও ন্যায্যতার দিকে মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।