‘মুভি’ দেখে ব্যাংকে হানা, সাড়ে ৩ ঘণ্টার নাটকীয়তার পর আত্মসমর্পণ
টুইট ডেস্ক : ব্যাংকে গ্রাহকরা জিম্মি, টাকা চাইছে ‘ডাকাত দল’; কার্যালয়ের বাইরে অসংখ্য মানুষের ভিড়, সংবাদমাধ্যমের পাশাপাশি ফেইসবুক পাতায় লাইভের পর লাইভ।
ঘটনা কোন দিকে যায় তা নিয়ে উৎকণ্ঠা আর কৌতুহল ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে চারিদিকে। শত শত মানুষের পাশাপাশি একে একে জড়ো হতে থাকে পুলিশ, সেনাসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। পুরো ব্যাংক শাখা ঘিরে ফেলে তারা।
এরমধ্যেই গ্রাহকদের জিম্মি করে ব্যাংক কর্মীদের অস্ত্রের মুখে রেখে মুক্তিপণ দাবির কথা ভেসে বেড়াতে শুরু করে সংবাদমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। অল্প সময়ের মধ্যে সবার নজর গিয়ে পড়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জের রূপালী ব্যাংকের জিঞ্জিরা শাখায়।
নাটকীয়তা শেষে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর সন্ধ্যায় রুদ্ধশ্বাস সেই ঘটনার ইতি ঘটে বড় কোনো অঘটন ছাড়াই। তবে ডাকাতদের হানার এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর রাত পর্যন্ত ওই ভবন ঘিরে ছিল মানুষের ঢল।
ঘটনার শেষে সামনে আসে একদল তরুণ অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় মেতে উঠে নেমে পড়েছিল এমন দুঃসাহসিক কাজে। তুলে ধরে ‘এক দুস্থ কিডনি রোগীকে বাঁচানোর’ মানবতা তাদের সাহসী করেছিল।
আইফোনের প্রতি দুর্বার আকর্ষণ থেকে টাকা জোগাড়ের কথাও প্রাথমিক জেরার মুখে বলেছে তিন তরুণের এ ‘ডাকাতদলের’ একজন। এদের মধ্যে দু’জন আবার কিশোর।
প্রথমে অস্ত্র থাকার কথা বলা হলেও পরে পুলিশের ভাষ্য, তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া চার পিস্তলের তিনটিই খেলনা আর একটি পিস্তলের মত দেখতে লাইটার। তবে তাদের কাছে ছিল চকচকে দুটি ছুরি।
এগুলো নিয়েই তিনজনের এ দল বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে যখন কেরাণীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় রূপালী ব্যাংকের জিঞ্জিরা শাখায় ঢুকে পড়ে এবং গ্রাহকের জিম্মি করে তখন তা জানাজানি হতে না হতেই দ্রুত খবর ছড়িয়ে পড়ে। তাতে ব্যাংকের গ্রাহক ও কর্মী মিলে ১৬ জন ভেতরে জিম্মি দশায় পড়েন।
পরের সাড়ে তিন ঘণ্টা কাটে টান টান উত্তেজনায়। এমনকি ব্যাংকের ভেতরে অভিযানের প্রস্ততিও নেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিন ডাকাত আত্মসমর্পণ করে।
ব্যাংকের বাইরে রুদ্ধশ্বাস দীর্ঘ অপেক্ষার পর সন্ধ্যায় ডাকাতরা আলোচনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করলে, অক্ষত অবস্থায় বেরিয়ে আসেন ১৬ জন জিম্মি।
এরপর পুলিশ জানায়, ডাকাতি করতে আসা তিনজনের মধ্যে দুজনেরই বয়স ১৬। পুলিশ বলছে, ‘মুভি’ দেখে নকল চারটি পিস্তল আর দুটো ছুরি নিয়ে তারা সেখানে ‘অ্যাডভেঞ্চারে’ গিয়েছিল।
রাজধানী লাগোয়া পুরনো ব্যবসাকেন্দ্র জিঞ্জিরা। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানাধীন চুনকুটিয়ার একটি ভাড়া বাড়িতে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের এই শাখা।
দুপুর ২টার দিকে খবর ছড়ায় ব্যাংকে ডাকাত পড়েছে, এরপর বাইরে থেকে ভবনের মূল ফটক তালা মেরে দেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় ব্যবসায়ী শিহাব সরকার বলেন, ওই বাড়ির কেয়ারটেকার মাজেদ চিৎকার করে স্থানীয় লোকদের জানায় সেখানে ডাকাত পড়েছে।
পরে লোকজন জড়ো হয়ে ভবনের মূল ফটকে তালা মেরে দেয়। পরে মসজিদের মাইকে ডাকাতের হানার খবর প্রচার করা হয়। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে পুলিশ আসে। এরপর আসে র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা।
পুলিশের কেরাণীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যাংকের ওই শাখার চারপাশে অবস্থান নেয়। তারা ‘ডাকাতদের’ আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা চালান। পাশের একটি মসজিদের মাইক থেকেও আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানানো হয়।
প্রয়োজনে যাতে ব্যাংকের ভেতরে অভিযান চালানো যায়, সেই প্রস্তুতিও নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
ভেতরে জিম্মি ব্যাংকের ১০ কর্মী ও একটি শিশুসহ ছয়জন গ্রাহক। বাইরে অস্ত্র উঁচিয়ে অভিযানের প্রস্তুতিতে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, সোয়াটসহ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা।
প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির পর সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে তিন ডাকাত আত্মসমর্পণ করে। এরপর তাদের হেফাজতে নেয় নিরাপত্তা বাহিনী।
রাত ৮টার দিকে ঢাকার কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা জেলার এসপি আহম্মেদ মুঈদ বলেন, ব্যাংকে হানা দেওয়া তিনজনের মধ্যে দুজন ১৬ বছরের কিশোর; আর একজনের বয়স ২২, তিনি গাড়ি চালান।
তাদের কাছে থাকা চারটা পিস্তলই নকল জানিয়ে তিনি বলেন, “এর মধ্যে তিনটি খেলনা পিস্তল আর একটা লাইটার। তবে ওদের কাছে দুটো ছুরিও ছিল।”
এসপি বলেন, “তাদের অনেকক্ষণ ধরে জিজ্ঞাসাবাদের পর তার মনে হয়েছে বিভিন্ন ‘মুভি-টুভি’ এসব দেখে বা ফেইসবুক দেখে ওরা ‘অ্যাডভেঞ্চারের মতো’ করতে গিয়েছিল।”
একজন দুঃস্থ কিডনি রোগীর চিকিৎসার অর্থ সংগ্রহে তারা সেখানে গিয়েছে বলেও তিনজন পুলিশকে জানিয়েছে। পরে অবশ্য তারা বলেছে, তাদের আইফোন পছন্দ।
তাদের তিনজনের কাছে থাকা একটি ব্যাগ থেকে ১৫ লাখ ও প্রত্যেকের পকেট থেকে এক লাখ করে টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
এসপি বলেন, “৯৯৯ এর মাধ্যমে খবর পাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশের প্রথম দলটি সেখানে পৌঁছায়। ওখানে তখন ব্যাংকের ১০ জন স্টাফ ও ছয়জন ক্লায়েন্ট, এদের মধ্যে একটা বাচ্চাও ছিল।”
অনেক ‘দর কষাকষির পর’ তারা আত্মসমর্পণ করে জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “ওদের সাথে একটা মোবাইল ছিল। ওদের কাছ থেকে নম্বর নিয়ে কথা বলে বিষয়টিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছিল আমাদের এডিশনাল এসপি।
“আমাদেরকে আইজি স্যার লাইভে একটাই নির্দেশনা দিয়েছেন, সেটা হল কোনো জীবন যাতে এখানে না যায়। কোনো অস্ত্র ব্যবহার না করে যতটুকু পারা যায় আলোচনা করে সফল হতে হবে। তাই দীর্ঘ সময় নিয়ে কয়েক দফায় তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের কথা আমরা শুনেছি।”
কাদের সঙ্গে কী কথা হয়েছে, তা তুলে ধরে এসপি বলেন, “দর কষাকষির সময় তারা পুলিশকে বলে একজন দুঃস্থ রোগীর জন্য টাকা সংগ্রহে তারা এখানে এসেছে। তারা বলেছিল মৃত্যুশয্যায় একটা কিডনি রোগীকে বাঁচানোর জন্য তাদের টাকা দরকার। আমরা তখন প্রাথমিক পর্যায়ে (নেগোসিয়েশনের সময়) বলেছিলাম, ‘যত টাকা দরকার তোমরা নাও, আমরা পৌঁছায় দেব’।”
সেই কিডনি রোগীর নাম ও ঠিকানাও তারা দিয়েছে জানিয়ে এসপি মুঈদ বলেন, “এখনও আমরা যাচাই করছি। এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না ওদের উদ্দেশ্য কী ছিল। ওরা আবার আইফোন কেনার একটা কথা বলেছে, আইফোন ওদের পছন্দ।“ তিনি বলেন, কারও ক্ষতি না করতে বারবার পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।
“ওরা কথা দেয় কারও ক্ষতি করবে না। আমরা তখন তাদের এপ্রিসিয়েট করেছি। তাদের ছোটভাই বলে, সন্তান বলে বারবার বুঝিয়েছি। আমরা বলেছি, তোমাদের এখানে কোনো দোষ দিচ্ছি না। অনেকভাবে আমরা কথা বলে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত কনভিন্সড করতে পেরেছি।”
এরপর ‘ডাকাতরা’ই আত্মসমর্পণের কথা বলে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি বলেছি আগে অস্ত্র দিয়ে দিবা, তারপরে তোমরা টাকা নিয়ে বের হয়ে আসবা।”
আটক তিনজন কী করত জানতে চাইলে এসপি মুঈদ বলেন, “ওরা পড়াশোনা করেছে, মাদ্রাসার ছাত্র। একজনের ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। প্রাইভেট গাড়ি চালাত, তার বাড়ি গোপালগঞ্জে কাশিয়ানী। বাকি দুজন এখানকার লোকাল।”
আলোচনার সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোগীর জন্য এ রকম টাকা তো অনুদান দেওয়া যেত। তখন তারা বলে, “ব্যাংকের কর্মকর্তারা সব দুর্নীতিবাজ।”
ওদের অপরাধীও বলতে চান না এসপি। তিনি বলেন, “ওদেরকে অপরাধী বলাটা… আমার মনে হচ্ছে তারা কোনোভাবে মিসগাইডেড। অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে নেওয়ার মত মনে হয়েছে।”
ব্যাংকে ঢোকার পরের পরিস্থিতি বর্ণনা দিয়ে এসপি বলেন, “ব্যাংকের যে সিকিউরিটি গার্ড তিনি তার সিটে ছিলেন না। কিন্তু ওই সময় আরেকজন পিয়নকে গার্ডের চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। ওরা যেহেতু আর্মস নিয়ে ঢুকেছে, টিনএজ, সবাই ভয় পেয়েছে। সবাইকে হেডডাউন করতে বলেছিল। পরে ওরা ভেতরে আটকা পড়ে যায়।
“ওরা ব্যাংকে বলেছিল ওদের আরও লোক আছে আশপাশে। পরে জিজ্ঞাসাবাদে ওরা বলেছে এগুলো ‘আপনাদের ভয় দেখানোর জন্য বলেছিলাম’।”
এসপি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে এদের সম্পৃক্ততা আছে কি না, এদের কোন ‘বড়ভাই’ গাইড করেছে কী না এসব খতিয়ে দেখবে পুলিশ। আর তারা যেহেতু অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদের বিরুদ্ধে কী আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে সেটাও চিন্তা করে দেখা হচ্ছে।”