বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে কেপিআই; বৈষম্যের কারণ হতে পারে
বদিউল আলম লিংকন: ব্যাংকিং খাতে কর্মক্ষমতা পরিমাপ ও উন্নয়নের জন্য Key Performance Indicators (KPIs) একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা নির্ধারণ, ব্যাংকের ব্যবসায়িক লক্ষ্য অর্জন এবং সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। তবে, বাংলাদেশে এই ব্যবস্থার কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা কর্মীদের মধ্যে বৈষম্যের অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে। সঠিকভাবে প্রয়োগ না হলে এটি প্রত্যাশিত ফলাফল আনতে ব্যর্থ হয় এবং কর্মক্ষেত্রে অসন্তোষের পরিবেশ তৈরি করে।
কেন KPIs বৈষম্যের কারণ হতে পারে?
KPI ব্যবহারে বৈষম্যের অনুভূতি তৈরি হওয়ার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে: KPI ব্যবস্থার উদ্দেশ্য কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলেও এর সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে বৈষম্যের পরিবেশ তৈরি হতে পারে। এজন্য বাস্তবতা, দক্ষতা এবং সামগ্রিক কাজের ধরণ অনুযায়ী KPI নির্ধারণ করতে হবে, যাতে এটি কর্মীদের জন্য একটি সমতাভিত্তিক এবং প্রেরণাদায়ক পদ্ধতি হিসেবে কাজ করে।
অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ:
অনেক ক্ষেত্রে কর্মীদের জন্য যে KPI নির্ধারণ করা হয়, তা তাদের কাজের বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। উদাহরণস্বরূপ, শহুরে শাখার কর্মীদের জন্য উচ্চ ঋণ বিতরণ বা আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা সহজ হলেও গ্রামীণ বা অনুন্নত অঞ্চলের শাখাগুলোর জন্য এটি প্রায় অসম্ভব। এই ব্যবধান কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে।
সামঞ্জস্যের অভাব:
বিভিন্ন কর্মীর জন্য ভিন্ন ভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হলে বৈষম্যের অনুভূতি তৈরি হয়। একই পদে কর্মরত দুই কর্মীর জন্য যদি ভিন্ন মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়, তবে একজন নিজেকে অবমূল্যায়িত মনে করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একজন ক্রেডিট অফিসার এবং একজন কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজের ধরণ ভিন্ন হলেও একই পারফরম্যান্স লক্ষ্য চাপিয়ে দেওয়া হতে পারে।
সহযোগিতা কমে যাওয়া:
শুধুমাত্র ব্যক্তিগত অর্জনের উপর KPI নির্ধারণ করলে টিমওয়ার্ক কমে যায়। এটি কর্মীদের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা তৈরি করে, যা দলগত সাফল্যের জন্য ক্ষতিকর।
সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ উপেক্ষা করা:
ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক পরিবেশ, এবং জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা না করেই KPI নির্ধারণ করা হয়। এর ফলে কিছু কর্মী তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, অন্যরা চাপে থাকে। উচ্চ আয়ের এলাকায় ঋণ বিতরণ বা আমানত সংগ্রহ সহজ। কম আয়ের এলাকায় একই লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়ে।
প্রণোদনার ব্যবধান:
অনেক সময় শুধুমাত্র KPI অর্জনের ভিত্তিতে প্রণোদনা প্রদান করা হয়, যা সৃজনশীলতা, উদ্যোগ, এবং অন্যান্য মানসিক গুণাবলিকে উপেক্ষা করে।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে KPIs-এর কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা:
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে KPI-এর সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কেবল কর্মক্ষমতা বাড়াবে না, কর্মক্ষেত্রের ন্যায়বিচারও প্রতিষ্ঠিত করবে। সেক্ষেত্রে কিছু সুপারিশ করা যেতে পারে:
বাস্তবসম্মত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ:
KPI নির্ধারণের সময় ভৌগোলিক, আর্থসামাজিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক বৈচিত্র্য বিবেচনা করা উচিত। প্রত্যেক শাখার জন্য আলাদা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা উচিত, যা সেই শাখার সামর্থ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কর্মীদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করা:
KPI তৈরি ও প্রয়োগের আগে কর্মচারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের মতামত সংগ্রহ করা উচিত। এটি কর্মীদের মধ্যে অংশগ্রহণের অনুভূতি তৈরি করবে এবং বৈষম্যের অভিযোগ কমাবে।
কর্মক্ষমতার মানসম্মত মূল্যায়ন:
শুধুমাত্র সংখ্যাগত লক্ষ্যমাত্রা নয়, বরং কাজের মান, সৃজনশীলতা, টিমওয়ার্ক এবং অন্যান্য দক্ষতা ও KPI-এর অংশ হওয়া উচিত।
স্বচ্ছতা ও পর্যালোচনা:
KPI নির্ধারণ এবং মূল্যায়নের পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। সময়ে সময়ে KPI পর্যালোচনা করে তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপডেট করা উচিত।
প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন:
KPI অর্জনে সমস্যাগ্রস্ত কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত। এটি তাদের দক্ষতা বাড়াতে এবং লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করবে।
সামগ্রিক সাফল্যের মূল্যায়ন:
ব্যক্তিগত লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি টিম এবং শাখার সামগ্রিক সাফল্যকেও বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এটি দলগত কাজের প্রতি কর্মীদের উৎসাহিত করবে।
KPI ব্যাংকিং খাতে কর্মক্ষমতা পরিমাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে এটি সঠিকভাবে ব্যবহৃত না হলে কর্মক্ষেত্রে অসন্তোষ, বৈষম্যের অনুভূতি এবং মানসিক চাপ বাড়াতে পারে। বাংলাদেশে KPI-এর ভূমিকা আরও কার্যকর এবং ন্যায়সংগত করতে হলে বাস্তবতা এবং মানবিক দৃষ্টিকোণকে প্রাধান্য দিয়ে এটি তৈরি ও প্রয়োগ করতে হবে। এর মাধ্যমে কর্মীরা তাদের কর্মক্ষেত্রে আরও উৎসাহী ও সম্পৃক্ত হতে পারবে এবং ব্যাংকিং খাত একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হবে।