তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শাটডাউনের প্রভাব
টুইট ডেস্ক : কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সংঘটিত সহিংসতার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে তৈরি পোশাক খাতেও। শাটডাউনের কারণে বন্দরের কার্যক্রম এবং পরেও ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় রপ্তানি পণ্য জাহাজীকরণে রপ্তানিকারকদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে বিলম্ব পুষিয়ে নিতে বিমানে করে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে তাদের। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় লাভের মুখ দেখা নিয়ে রায়েছে শঙ্কা। তাছাড়া ক্রয়াদেশ কমারও আশঙ্কা করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ার পাশাপাশি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে। এতে অনেক ক্রেতাই পরবর্তী অর্ডারগুলো দিতে এখন ইতস্তত বোধ করছেন বলে জানালেন রপ্তানিকারকরা। এর প্রভাব আগামী গ্রীষ্মকালীন রপ্তানির ওপর পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের জন্য গত ১৯ জুলাই (শুক্রবার) কারফিউ জারি করা হয়। এতে দেশের সব কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি ১৯ থেকে ২২ জুলাই এই চারদিন বন্ধ থাকে চট্টগাম বন্দরের কার্যক্রম। পাশাপাশি বন্ধ থাকে ইন্টারনেটও। পরবর্তীতে মঙ্গলবার বন্দরের কার্যক্রম চালুর পাশাপাশি বুধবার থেকে সারা দেশে পুরোদমে শুরু হয় সব পোশাক কারখানায় উৎপাদন। কিন্তু মাঝের এ শাটডাউনের ধাক্কা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে পোশাক রপ্তানির ওপর।
দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। বছরে প্রতিষ্ঠানটির রপ্তানির পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকার ওপর। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএর বর্তমান কমিটির পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, কারফিউ শিথিল করার কারণে এবং চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম ফের চালু হওয়ায় বর্তমানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পণ্য পাঠাতে সমস্যা না হলেও পাঁচদিনের শাটডাউনের প্রভাবে বুকিং নিয়ে সমস্যা হয়েছে। বিশেষ করে কনটেইনার পাওয়ার ব্যাপারে কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠানকে।
তিনি বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের রপ্তানিমুখী বেশকিছু পণ্যকে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী কনটেইনারে হ্যাংগারের মাধ্যমে প্যাকেটজাত করে কমলাপুর ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোর (আইসিডি) মাধ্যমে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হয়। বর্তমানে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় সম্ভব হচ্ছে না এ কনটেইনার লোডিং।
তিনি আরও বলেন, কমলাপুরে রপ্তানিকারকদের অনেক কনটেইনার এরই মধ্যে জমে আছে। যেগুলো চট্টগ্রামে পাঠানো যাচ্ছে না। রপ্তানি পণ্যবাহী এসব কনটেইনার যেন সময়মতো বন্দরে পৌঁছানোর মাধ্যমে জাহাজীকরণ করা যায়, সে ব্যাপারে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। কারণ বেশিরভাগ বড় রপ্তানিকারককেই তাদের ক্রেতাচাহিদা অনুযায়ী এভাবে হ্যাংগারের মাধ্যমে কনটেইনার ভর্তি করে পণ্য বিদেশে পাঠাতে হয়। তাই কমলাপুর আইসিডি থেকে অতি দ্রুত পণ্য লোড করা না গেলে সমস্যায় পড়বেন তারা।
শোভন ইসলাম বলেন, এরই মধ্যে বিজিএমইএর সঙ্গে ক্রেতাদের বৈঠক হয়েছে। সেখানে ক্রেতাদের পক্ষ থেকেও অতি দ্রুত যেন আটকে থাকা কনটেইনার জাহাজীকরণ করা যায়, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
এদিকে কনটেইনার আটকে থাকায় অনেক রপ্তানিকারককেই তার পণ্য যথাসময়ে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর জন্য এয়ার কার্গো শিপমেন্টের আশ্রয় নিতে হচ্ছে বলে জানান তিনি। এতে রপ্তানিকারকদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে অনেকটা। তবে ক্রেতাদের অনেকেই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে পণ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্রে এক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছেন বলে জানান শোভন ইসলাম। তবে মৌসুমের এ সময়ে পুরো রপ্তানি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারাও নিরুপায় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য শীতকালের পোশাক রপ্তানি মাত্র শুরু হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে পণ্য সঠিক সময়ে ক্রেতাদের হাতে না পৌঁছালে তাদেরও ক্ষতির সম্মুখীন হতে হবে।
তবে এরপরও অনেক ক্রেতাই এয়ার শিপমেন্টের খরচ বহন করতে রাজি হয়েছেন উল্লেখ করে শোভন ইসলাম বলেন, অবশ্য এক্ষেত্রে পণ্যের দামে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট চাচ্ছেন ক্রেতারা। যা আসলে গিয়ে দিন শেষে রপ্তানিকারকদের ঘাড়েই পড়বে। মুনাফা আর তেমন কিছুই থাকবে না। এতে মোট রপ্তানির এক-তৃতীয়াংশ হয়তো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারে।
বাকি দুই-তৃতীয়াংশ রপ্তানির ক্ষেত্রেই ক্রেতারা সময় বাড়াতে রাজি হয়েছেন বলে উল্লেখ করেন শোভন ইসলাম। এসব হতাশাজনক পরিস্থিতি সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত কোন অর্ডার ক্যানসেলের খবর পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। তার মতে, আপাতত দেশের গার্মেন্টস খাতের জন্য এটাই ভালো খবর।
তবে সাম্প্রতিক এ সহিংসতা ও শাটডাউনের কারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ইমেজের ওপর প্রভাব পড়ছে উল্লেখ করে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব দেশের পোশাক রপ্তানির ওপর পড়ার আশঙ্কার কথা জানান শোভন ইসলাম।
তিনি বলেন, স্বল্পমেয়াদে হয়তো তেমন কোন প্রভাব পড়বে না, কারণ ডিসেম্বর পর্যন্ত উইন্টার সিজনের সব অর্ডার তো শেষ করা হয়েছে। তবে সমস্যা হতে পারে আগামী বছরের সামার বা গ্রীষ্মকালীন পণ্যের রপ্তানির অর্ডার পাওয়ার ক্ষেত্রে। এতে ইমেজ সঙ্কটের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়তে পারে।
পশ্চিমা বিশ্বের ক্রেতাদের অনেকেই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতাকে ভালোভাবে নেয়নি বলে উল্লেখ করেন শোভন ইসলাম। তার মতে, সেখানকার শিশু ও কিশোরদের মনোজগতে বাংলাদেশের ছাত্রদের প্রাণহানির বিষয়টি বেশ প্রভাব ফেলেছে।
সবকিছু বিবেচনায় সাম্প্রতিক এ ধাক্কার কারণে আগামী বছর দেশের গার্মেন্টস রপ্তানির ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অর্ডার কম হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। এ পরিস্থিতিকে বিশাল একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে এ থেকে উত্তরণে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করার আহবান জানান তিনি।
এদিকে, টেক্সটাউন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ পরিচালক আনোয়ার হোসেন মানিক বলেন, সাম্প্রতিক সহিংসতা ও শাটডাউনের কারণে দেশের পোশাক রপ্তানি খাতের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়তে যাচ্ছে। কারণ যে সময়ে এ ঘটনা ঘটলো, সেই সময়টা পোশাক রপ্তানির কার্যক্রমের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়েই শীতকালীন রপ্তানি পণ্যের ডেলিভারি শুরু হওয়ার পাশাপাশি একই সঙ্গে আগামী বছরের গ্রীষ্মকালীন রপ্তানি পণ্যেরও অর্ডার নেয়া হয়।
বিশেষ করে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টি ক্রেতাদের জন্য বিশেষ অসুবিধা তৈরি করেছে বলে উল্লেখ করেন আনোয়ার হোসেন। এতে ক্রেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রাখতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। পাশাপাশি এ ধরনের সহিংসতা হতে পারে এ বিষয়টিও কল্পনার বাইরে ছিলো পোশাক উদ্যোক্তাদের। এর ফলে বাংলাদেশের যে ইমেজ সঙ্কট হলো তার প্রভাব আগামী গ্রীষ্মকালীন অর্ডারের ওপর পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন তিনি।
তিনি বলেন, অনেক বায়ারই অর্ডার দেয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করলেও এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানাতে ইতস্তত করছে। এর মানে এ নয় যে, তারা অন্য দেশে এখনই অর্ডার দিয়ে দেবেন। তারা বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। যদি এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে কিংবা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে, সেক্ষেত্রে হয়তো তারা ভিন্ন চিন্তা করতে পারে। সেক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়বে দেশের সার্বিক রপ্তানি আয়ে।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক নানা সঙ্কটের কারণে এমনিতে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে নেতিবাচক প্রবণতায় দেশের পোশাক রপ্তানি খাত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী এ খাতে মোট রপ্তানি আয় কমেছে ৫.২ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ গত অর্থবছরের জুলাই-মে মাসে আয় করেছে ৩৩.০৪ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ৩৪.৮৬ বিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে নিট পোশাকের রপ্তানি আয় ৫.৩ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ১৭.৬০ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছর ছিল ১৮.৫৮ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ওভেন পোশাকপণ্যের আয় কমেছে ৫.১ শতাংশ। এ থেকে আয় হয়েছে ১৫.৪০ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরে একই সময়ে ছিল ১৬.২২ বিলিয়ন ডলার।
এ পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও শাটডাউনের প্রভাব দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের ওপর নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।