৩৫ টাকার ডাব বিক্রি হচ্ছে ১৬০ টাকায়
টুইট ডেস্ক : তীব দাবদাহে সারা দেশের মতো কুমিল্লায়ও ডাবের চাহিদা বেড়েছে। এই সুযোগে বাড়তি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে ডাব সিন্ডিকেটের। লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর বাগান মালিকরা যে ডাব ৩৫ টাকায় বিক্রি করছেন সেই ডাব কুমিল্লায় বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৬০ টাকায়।
মাত্র তিন হাত ঘুরতেই প্রতিটি ডাবের দাম বাড়ছে ১০৫-১২৫ টাকা। অভিযোগ উঠেছে, সিন্ডিকেটের বাইরে কেউ ওই দুই জেলার পাইকারি বাজার থেকে ডাব সংগ্রহ করতে পারেন না। এক্ষেত্রে তাদের বাধা, হয়রানি ও মারধরের শিকার হতে হয়।
সিন্ডিকেটের সঙ্গে কতিপয় পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহল জড়িত থাকায় এ নিয়ে মামলা কিংবা কথা বলতেও ভয় পান ভুক্তভোগীরা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়-বিক্রয় তদারকি করলেও ডাব সিন্ডিকেটের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসনেরও এ বিষয়ে কোনো নজরদারি নেই।
জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বেশি ডাবের ফলন হয় লক্ষ্মীপুরে। এ জেলার আড়াই হাজার হেক্টর জমিতে নারকেলের বাগান রয়েছে। তাছাড়া প্রতিটি বাড়িতে কমবেশি নারকেল গাছ আছে। প্রতিবছর এ জেলা থেকে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ডাব ও নারকেল বাজারজাত করা হয় বলে জানায় জেলা কৃষি বিভাগ।
এরপর ডাবের ফলনের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নোয়াখালী। এ দুটি জেলার বিভিন্ন পাইকারি হাট থেকে কুমিল্লায় প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ ট্রাক ডাব আমদানি হয়। লক্ষ্মীপুর সদর, জেলার হায়দরগঞ্জ, মীরগঞ্জ, দালাল বাজার, মান্দারী বাজার, জকসিন বাজার, কমলনগর বাজার, ভবানীগঞ্জ, মুজো চৌধুরী ঘাট এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ বাজার, চৌমুহনী বাজার, চন্দ্রগঞ্জ বাজার, রামগঞ্জ ও সুবর্ণচরের পাইকারি হাট থেকে এসব ডাব আসে।
লক্ষ্মীপুরের কৃষক ও বাগান মালিকরা স্থানীয় আড়তদারদের কাছে বড় সাইজের প্রতিটি ডাব বিক্রি করছেন সর্বোচ্চ ৩৫ টাকায়। আড়তদাররা এসব ডাব পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন ৫০ টাকায়।
লক্ষ্মীপুর সদরের পাইকারি ডাব ব্যবসায়ী (আড়তদার) মো. শাহ আলম ও আমির হোসেন একই রকম তথ্য দিয়ে বলেন, আমরা বাগান মালিকদের কাছ থেকে প্রতিটি বড় সাইজের ডাব ৩৫ টাকায় কিনি। এসব ডাব গাছ থেকে সংগ্রহ করে পিকআপে আড়তে আনতে প্রতিটি ডাবে কমপক্ষে ৫ টাকা খরচ হয়। তারপর খাজনা ও গদি খরচ আছে। আমরা ৫-১০ টাকা লাভে সর্বোচ্চ ৫০ টাকায় এসব ডাব ঢাকা ও কুমিল্লার পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি।
তারা আরও বলেন, প্রতিটি ডাব লক্ষ্মীপুর থেকে কুমিল্লায় পৌঁছতে ট্রাক-পিকআপ ভাড়া এবং লোড-আনলোড খরচ মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৫ টাকা করে খরচ হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি ডাব ১৪০ টাকায় বিক্রি করা ডাকাতির শামিল।
নোয়াখালীর চন্দ্রগঞ্জ বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী মকবুল হোসেন বলেন, আমরা ছোট-বড় মিলিয়ে প্রতিটি ডাব গড়ে ৪০-৪৫ টাকায় বিক্রি করি। আমাদের কাছ থেকে কুমিল্লা ও ঢাকার ব্যবসায়ীরা এসব ডাব ক্রয় করছে। আমরা বিক্রি করার পর কোথায় সিন্ডিকেট কি করল সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ বলেন, এ বছর সুবর্ণচরে ডাবের প্রচুর ফলন হয়েছে। চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত ফলন হওয়ায় বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে।
জানা যায়, কুমিল্লা নগরীতে প্রায় ৫০টি স্পটে খুচরা বিক্রেতারা ডাব বিক্রি করেন। এছাড়া ১৭ উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে আরও দুই শতাধিক বিক্রেতা রয়েছেন। সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতিদিন আবহাওয়া বুঝে ডাবের বিক্রয় মূল্য নির্ধারণ করে দেন। খুচরা বিক্রেতাদের কোনো পুঁজি লাগে না। সিন্ডিকেট থেকে তাদের ডাব দেওয়া হয়। বিক্রির পর প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা টাকা জমা দেন। সিন্ডিকেটের নির্ধারিত মূল্যের বাইরে খুচরা বিক্রেতারা প্রতিটি ডাবে ২০-৩০ টাকা মুনাফা করেন।
নগরীর ধর্মসাগর পাড়ের ডাব বিক্রেতা সোহেল রানা বলেন, আমরা তো লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর পাইকারি বাজার থেকে ডাব ক্রয় করতে পারি না। এখানে সিন্ডিকেটের লোকেরা তা নিয়ে আসে। আমাদের কোনো পুঁজি লাগে না। বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করে দেই। সিন্ডিকেটের বেঁধে দেওয়া মূল্য থেকে আমরা প্রতিটি ডাবে ১০-২০ টাকা লাভ করি।
সূত্র জানায়, কুমিল্লায় ডাব সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন আব্দুর রহিম, মাহফুজুর রহমান, শাহজাহান মিয়া, দুলাল মিয়া, অন্তর, হারু চন্দ্র ও শিব নারায়ণ গং। এ সিন্ডিকেটের বাইরের কেউ ওইসব পাইকারি বাজার থেকে ডাব আনতে গেলে তাদের বাধা, হয়রানি এমনকি মারধরও করা হয়।
একাধিক ভুক্তভোগী ডাব ব্যবসায়ী জানান, সম্প্রতি তারা সিন্ডিকেট সদস্যদের পাশ কাটিয়ে নিজেদের উদ্যোগে নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুরের পাইকারি হাট থেকে ডাব ক্রয় করতে গিয়ে ব্যাপক মারধরের শিকার হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে টাকাও হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে সিন্ডিকেট সদস্য শিব নারায়ণ বলেন, আমরা লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী থেকে সংগ্রহ করা প্রতিটি ডাব খুচরা বিক্রেতাদের কাছে ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি করি। খুচরা বিক্রেতারা অতিরিক্ত মুনাফা করলে এর দায় আমরা কেন নেব। এছাড়া অন্যান্য অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
আরিফুল ইসলাম, হুমায়ূন আহমেদ, ফয়সাল তূর্যসহ কয়েকজন ভোক্তা অভিযোগ করেন, ডাব সিন্ডিকেট নৈরাজ্য করলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
কুমিল্লা কোতোয়ালি থানার ওসি ফিরোজ হোসেন বলেন, আমাদের কোনো পুলিশ সদস্য ডাব বিক্রেতা কিংবা সিন্ডিকেট সদস্যের সঙ্গে জড়িত নয়। তাদের কাছ থেকে টাকাও নেয় না।
কুমিল্লা ট্রাফিক বিভাগের প্রধান জিয়াউল চৌধুরী বলেন, ডাবভর্তি ট্রাক এলে আমরা সহযোগিতা করি। কারণ নগরীতে ডাবের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতি রাতেই ডাবের চালান নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে আনলোড করা হয়। এ সময় কোনো হকার অথবা ডাব বিক্রেতার কাছ থেকে আমাদের ট্রাফিক সদস্যরা টাকা নেন না।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কুমিল্লার সহকারী পরিচালক আছাদুল ইসলাম বলেন, এর আগে ডাব বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে একাধিক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। তাদের মনিটরিং ও তদারকি করা হচ্ছে। অতিরিক্ত মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার কাজে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।