ব্যাংক ঋণের সুদ বৃদ্ধি: ব্যবসায়ীরা হতাশ, এপ্রিলে ছাড়াবে ১৩ শতাংশ

টুইট ডেস্ক: ব্যাংক ঋণের সুদের হার প্রতি মাসেই বাড়ছে, এটা ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের জন্য একটি বেশ কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এপ্রিলে ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সুদের হার বেড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এই নতুন সুদের হার প্রযোজ্য হওয়া শুরু হচ্ছে আজ (১ এপ্রিল) থেকে।

বেসরকারি বিনিয়োগকারী ও ভোক্তাদের উপর এটা প্রভাব ফেলবে। আর ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণের সুদহার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন নির্দেশিকা অনুসারে, ঋণের সুদের হার প্রতি মাসে পরিবর্তন হবে। এই সুদের হারের পরিবর্তনের ফলে বিপাক পায় ব্যাংকের ঋণগ্রহীতাদের মাঝে। ব্যাংকের ঋণের সুদের বৃদ্ধির পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকবাহির আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এটির প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগকারীরা তাদের ব্যবসার ব্যয় ঠিক রাখতে পারতে পারছেন না। এতে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় এবং পণ্যের দামের বৃদ্ধি। এর ফলে ভোক্তারা বেকায়দায় পড়ছেন।

সুদের বৃদ্ধির পরিবর্তনের সাথে সাথে ব্যাংকের আদায়ের প্রতিশ্রুতি আরও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে। ব্যাংকগুলো তাদের আদায়ের প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য ক্রমাগত নতুন নির্দেশনা গ্রহণ করছে। সুদের বৃদ্ধি এবং আদায়ের প্রতিশ্রুতি সমন্বয়ে ব্যাংকগুলো তাদের আর্থিক স্থিতি উন্নত করার চেষ্টা করছে।

ব্যবসায়ীরা উপলব্ধি করেছেন, সুদের বৃদ্ধির কারণে এখন প্রতি মাসেই ব্যাংক ঋণের সুদ বাড়ছে। নতুন করে ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে সুদের হার বেশি হবে। এর ফলে ব্যবসার খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

সুদহার নির্ধারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন একটি নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করছে। এর ফলে ঋণের সুদ এখন প্রতি মাসেই বাড়ছে। গত ফেব্রুয়ারিতে ব্যাংকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ ছিল ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। মার্চে তা বেড়ে হয় ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ। এর আগে ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদের হার নির্ধারিত ছিল ৯ শতাংশে। গত জুলাই মাসে সুদের হার বেঁধে দেওয়ার ঐ পদ্ধতি থেকে সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল বা স্মার্ট পদ্ধতিতে ঋণের সুদের ভিত্তি হার নির্ধারিত হয়। এই ভিত্তি হারের সঙ্গে যুক্ত হয় বাড়তি ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ সুদ। এ দুইয়ে মিলে ঋণের চূড়ান্ত সুদহার নির্ধারণ করে ব্যাংকগুলো। মার্চ মাস শেষে স্মার্ট হার ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশে। এর সঙ্গে ৩ শতাংশ সুদ যুক্ত করলে ঋণের সুদ দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে এখন প্রতি মাসেই ঋণের সুদ বাড়ছে। নতুন করে ব্যাংকঋণ নিতে গেলেই গুনতে হচ্ছে বেশি সুদ। এর ফলে ব্যবসার খরচও বেড়ে যাচ্ছে।

ঋণের সুদহার বাড়ার কারণে ব্যবসার ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ৯ শতাংশ থেকে এক লাফে ১৪ শতাংশে সুদ বেড়ে যাওয়া হচ্ছে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। গ্যাসের দাম বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, শ্রমিকমূল্য ৭০ শতাংশ বেড়েছে। সব কিছুর বাড়তি বাজারে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকতে কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২০ সালের এপ্রিলে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশে নির্ধারণ করে দিয়েছিল। তবে অর্থনীতিতে সংকট শুরু হলে গত বছরের জুন থেকে ব্যাংকঋণের সুদহার নির্ধারণে নতুন পদ্ধতি স্মার্ট চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারের ট্রেজারি বিলের ছয় মাসের গড় সুদহারের ভিত্তিতে ব্যাংকের এ সুদহার নির্ধারিত হচ্ছে। প্রতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক স্মার্ট সুদহার প্রকাশ করে।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বহুল আলোচিত-সমালোচিত ‘৯-৬ সুদহার’ উঠিয়ে নেওয়ার পর ঋণের সুদহার বেড়ে এখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছে। ব্যাংকের ঋণের ওপর সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯ শতাংশ, আর আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৬ শতাংশ। ঋণের সুদহার বাড়ার পাশাপাশি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এখন আমানতের ওপর সুদের হারও বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য মুদ্রানীতি কমিটি কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব স্মার্টের ওপর ইতিমধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ঋণের সুদহার মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা এবং অর্থনৈতিক গতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ঋণের সুদহার নির্ধারণের ক্ষেত্রে নতুন নির্দেশনা পালন করতে হবে।

তবে অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় কমিয়ে দিয়েছেন মানুষ। আবার করোনার কারণে দুই বছর ঋণ পরিশোধে ছাড় পাওয়ায় ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ও কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলোতে ঋণ দেওয়ার মতো তহবিল কমে এসেছে। আবার শরিয়াভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংক তারল্যসংকটে পড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো টাকা জমা রাখতে পারছে না। কোনো কোনো ব্যাংক এখন আমানত সংগ্রহে ১০ শতাংশের বেশি সুদ দিচ্ছে। তবে বেশি তারল্যসংকটে থাকা কোনো কোনো ব্যাংক ১২ শতাংশ সুদেও আমানত নিচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়ায় তারল্যসংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ব্যাংকাররা। কারণ, ঋণের কিস্তি পরিশোধের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক ঋণগ্রহীতার কিস্তি অনিয়মিত হয়ে যেতে পারে। ব্যাংকাররাও বলছেন, সুদহার সহনীয় থাকলে ব্যবসায়ীদের জন্য ভালো হয়। কারণ, সুদহার বেড়ে গেলে গ্রাহকের কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায়। অনেক গ্রাহক ঋণ পরিশোধে বিলম্ব করেন। এমনিতে ঋণ আদায় কমে গেছে। এখন সুদহারের কারণে তা আরও কমতে পারে। অন্যদিকে, শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা একপ্রকার কঠিন সময় পার করছেন। অনেকেই লোকসানের ধকল কাটাতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছেন।