কেন বাড়ছে বিবাহবিচ্ছেদ?

 টুইট ডেস্ক: দেশে বিয়ের হার বৃদ্ধির পাশাপাশি বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকও বেড়েছে। বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান দুটি কারণ হচ্ছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়া (২২.৬ শতাংশ) এবং দাম্পত্য জীবন চালিয়ে যাওয়ার অক্ষমতা (২২.১ শতাংশ)। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এমন পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করা এবং একে অন্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার পরামর্শ দিয়েছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) ২০২২ শীর্ষক এ জরিপ গত ৩১ জানুয়ারি প্রকাশ করে বিবিএস।

বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি

বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়ে স্থূল বিবাহ বিচ্ছেদের হার শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। তবে ২০২২ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৪-এ দাঁড়ায়। তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের দুই ধরনের হার বিবিএসের জরিপে পাওয়া পায়। একটি হলো স্থূল বিচ্ছেদ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিবাহবিচ্ছেদের হার।

অন্যটি হলো সাধারণ বিবাহ বিচ্ছেদের হার, যাতে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের হিসাব করা হয়। বিবিএস জানিয়েছে, সংস্থাটি বিচ্ছেদ হওয়া মানুষের নিবিড় সাক্ষাৎকার নিয়ে জরিপটি করেছে। ফলে এই জরিপের মাধ্যমেই বিচ্ছেদের আসল কারণ উঠে এসেছে।

বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ

তালাক বা দাম্পত্য বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক। এ কারণে ২২.৬ শতাশ বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে। এরপরই রয়েছে দাম্পত্য জীবন পালনে অক্ষমতা। এ কারণে ২২ দশমিক ১ শতাংশ বিচ্ছেদ ঘটছে।

অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অক্ষমতা ও অস্বীকৃতি ১০ দশমিক ৬ শতাংশ, পারিবারিক চাপ ১০ দশমিক ২ শতাংশ, যৌন মিলনে অক্ষমতা বা অনীহা ৪ দশমিক ২ শতাংশ।

পরকীয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপরের অবস্থান রংপুর বিভাগের ২৬ শতাংশ এবং সবচেয়ে কম ময়মনসিংহ বিভাগে ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে সিলেট বিভাগে ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।

মুসলমানদের মধ্যে তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছেদের ঘটনার কারণগুলো জাতীয় হারের মতোই। তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এটির ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী চিত্র লক্ষ করা যায়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রে তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছেদের সবচেয়ে বড় কারণ হলো দাম্পত্য জীবন বজায় রাখতে অক্ষমতা ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এরপর রয়েছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ।

অন্যদিকে, স্থুল বিবাহবিচ্ছেদ হার ২০২১ সালে দশমিক ১৫ থেকে ২০২২ সালে দশমিক ২৯-এ দাঁড়িয়েছে, এক বছরে যা ৯৩ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ সময়ের মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রে পৃথক থাকার গড় বয়সের (এসএমএএম) মধ্যে খুবই নগণ্য ও অসঙ্গতিপূর্ণ বৃদ্ধি লক্ষ করা গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থূল তালাকের হারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা গেছে।

২০০৬ সালে স্থুল তালাকের হার ছিল দশমিক ৬, যা ২০২২ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ১ দশমিক ৪-এ উন্নীত হয়েছে। এ সময়ের ব্যবধানে পুরুষদের বিবাহের গড় বয়সে (বৈবাহিক অবস্থা নির্বিশেষে) কার্যত কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। এ সময়ের ব্যবধানে নারীদের বিবাহের গড় বয়সেও তেমন বৃদ্ধি দেখা যায়নি। প্রথম বিবাহের গড় বয়স গত ১০ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে স্থির বয়েছে।

বিয়ের হার

জরিপে দেখা গেছে, স্থূল বিবাহের অনুপাত গত ১৭ বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালে প্রতি হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে এর অনুপাত ছিল ১২ দশমিক ৪, যা ২০২২ সালে ১৮ দশমিক ১-এ উন্নীত হয়েছে। এ সময়ের ব্যবধানে সূচকটিতে উল্লম্ফন ঘটেছে প্রায় ৪৬ শতাংশ।

এ ছাড়া ২০০৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে পুরুষ ও নারী উভয়ের মধ্যেই সাধারণ বিয়ের হার উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৬ সালে পুরুষের ক্ষেত্রে এ হার ছিল প্রতি হাজারে ১৮ দশমিক ৩ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ছিল ২১ শতাংশ। তা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে পুরুষদের সাধারণ বিয়ের হার ৫২ দশমিক ৮ এবং নারীদের ক্ষেত্রে ৪৯ দশমিক ২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ বিয়ের হারে নারী-পুরুষের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই।

তবে ধর্মভেদে তারতম্য দেখা যায়। মুসলমানদের মধ্যে হারটি বেশি ২৬। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তা ১৮-এর কিছু বেশি। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীর ক্ষেত্রে সাধারণ বিয়ের হার ১৫-এর মতো।

জরিপে নারী ও পুরুষরা প্রথম বিয়ে কত বছর বয়সে করেছেন, তার একটি গড় হিসাব উঠে এসেছে। বিবিএস বলছে,

পুরুষের বিয়ের গড় বয়স ছিল ২৪ বছর। নারীর ক্ষেত্রে তা ১৮ দশমিক ৪ বছর। শহরে পুরুষ ও নারীর প্রথম বিয়ের গড় বয়স একটু বেশি। গ্রামে কম। শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণে তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটনার ক্ষেত্রে উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সম্পদশালী হওয়া উভয় ক্ষেত্রেই একটি বিপরীতমুখী সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়েছে।

বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি এবং এর প্রধান কারণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, বিবাহ বিচ্ছেদের ফলে মানবজীবনে নানা ধরনের সংকট তৈরি হয়। সামাজিকভাবেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বড় সমস্যায় পড়ে শিশুরা। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদে শিশুমনে বড় প্রভাব পড়ে। এমনি বৃদ্ধ বাবা-মাও বিপাকে পড়েন। শিশুদের নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বামী-স্ত্রীর বৈধ সম্পর্কের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে বিবাহ। যখনই বিবাহ ছাড়া একজন পুরুষ ও নারী সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তখনই তাদের সম্পর্ক সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে অবৈধ সম্পর্ক বলে। এটাকে পরকীয়া সম্পর্ক বলা হয়। এই সম্পর্ক পরিবার, সমাজ ও ধর্ম কোথাও বৈধতা নেই। ফলে শুরু হয় অ অশান্তি। এই সম্পর্ক থেকে বেরি আসার জন্য সমাজিক ও ধর্মীয় মূল্য বোধকে জাগ্রত করার পরামর্শ দেন এই সমাজ বিজ্ঞানী।