মিয়ানমারে সংঘাত: সামরিক বাহিনী প্রতিদিন পরাজয়ের মুখে

সংগৃহীত ছবি-বাংলা-রাখাই বর্ডার গার্ড স্টেশন। (ফেব্রুয়ারী ৪, ৫ ও ৬ মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ফেলে যাওয়া অস্ত্র ও গোলাবারু)। আরএসও ক্যাম্প সম্পূর্ণরূপে রাখাইন সেনাবাহিনীর দখলে ।

টুইট ডেস্ক: মিয়ানমারের জান্তা সরকার সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার তিন বছর পর অনুমান করা হচ্ছে, এই মুহূর্তে তারা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি পার করছেন। বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমনে প্রতিদিন পরাজয়ের মুখে পালাচ্ছে তারা। এতটা কোণঠাসা পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীকে এর আগে আর পড়তে দেখা যায়নি বলে সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম আড়াই বছর সামরিক বাহিনী দমন-পীড়নের মাধ্যমে যতটা সহজে তাদের ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিল পরে পরিস্থিতি উল্টে যায়।

২০২১ সালের এপ্রিলেই ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়ী সদস্যরা জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠন করে, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় এনইউজি। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা এতে যোগ দেয়।

সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে থাকা বিদ্রোহী বাহিনীর সঙ্গে মিলে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে এবং সব গোষ্ঠীর সমন্বয়ে তৈরি করে ‘‘পিপল ডিফেন্স ফোর্স’’।

সামরিক বাহিনীর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ নতুন মাত্রা পায় উত্তরাঞ্চলের তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী এক হয়ে আক্রমণ শুরুর পর।

২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে সুসংগঠিতভাবে হামলা চালায় দেশটির উত্তরের শান রাজ্যের জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু তিনটি বিদ্রোহী বাহিনী, যাদের একসঙ্গে ডাকা হচ্ছে ‘‘থ্রি গ্রুপ অ্যালায়েন্স’’ নামে।

ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ) নিয়ে এই জোট গঠন করে। তারা একে নাম দিয়েছে ‘‘অপারেশন ১০২৭’’।

এছাড়াও শত শত সাধারণ মানুষও এই জাতিগত বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দেয়। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে তারা প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করে।

বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে সামরিক টহল চৌকি, অস্ত্রাগার ও বেশ কিছু শহরের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে বিদ্রোহীদের হাতে।

মিয়ানমারের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র যোদ্ধারা এখন দেশটির অনেক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে । ফাইল ছবি : রয়টার্স

সামরিক বাহিনীকে এই মুহূর্তে সারা দেশ জুড়েই হামলার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

এই সংকট গভীর হওয়ার একটা বড় কারণ হলো সামরিক বাহিনী কিংবা বিদ্রোহী বাহিনীর কেউই শান্তি আলোচনার জন্য বসতে রাজি হয়নি, এমনটিই মন্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যমের।

স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সাথে সামরিক বাহিনীর সংঘাত চলমান থাকলেও, সাম্প্রতিক সময়ে সেই সংকট সামাল দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা।

অক্টোবরে হামলা শুরু হবার পর থেকে হাজার হাজার সৈন্য তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দখলে থাকা অনেক শহর ও এলাকা বিদ্রোহীরা নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে।

মিয়ানমারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করা বিশেষজ্ঞদের একটি দল যারা ‘স্পেশাল অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল ফর মিয়ানমার’ নামে পরিচিত, তাদের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির জান্তা সরকারের ‘পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ’ রয়েছে মাত্র ১৭ শতাংশ ভূখণ্ডের উপর, ২৩ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের দখলে রয়েছে ৫২ শতাংশের মতো ভূখণ্ড।

থাইল্যান্ড ভিত্তিক মিয়ানমারের সংবাদ মাধ্যম ইরাবতীতে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, সামরিক বাহিনী জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশে ৩৩টি শহরের দখল হারিয়েছে। এর মধ্যে চিন, সাকাই, কিয়াং প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের শান এবং শিন রাজ্য উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আরাকান আর্মিরা দখলে নিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ হয়েছে।

জানুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন ও আরাকান রাজ্যেও যুদ্ধ-পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।

দু’পক্ষের সংঘাত এতটাই তীব্র আকার নেয় যে চলতি বছরের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি থেকে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপি পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে শুরু করে।

এর আগে শত শত সৈন্য সীমান্ত দিয়ে চীন ও ভারতে পালিয়েছে। যুদ্ধ না করেই হাজার হাজার সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে।

অভ্যুত্থানের পর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত জান্তা সরকার ৩০ হাজারের মতো সেনা হারিয়েছে। যেখানে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীতে সেনার সংখ্যা মাত্র দেড় লাখ।

সামরিক বাহিনী প্রতিদিনই পরাজয়ের মুখে পড়ছে এবং দখল হয়ে যাওয়া ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এমন অবস্থায় সামরিক বাহিনী দ্রুত জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারাচ্ছে। এই অবস্থায় মিয়ানমার সরকারের পক্ষে নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজটি বেশ কঠিন।

এদিকে ‘জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র এক হিসাব বলছে, গত তিন বছরে রাজনৈতিক ও জাতিগত সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশটির ২৬ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিকভাবে শরণার্থী হতে বাধ্য হয়েছে’।

এ সময়ে সেখানকার অর্থনীতিতেও ধস নামে। জ্বালানির দাম এই সময়ের মধ্যে প্রায় চার গুণ বেড়ে যায়। পণ্যের দামও বাড়ে লাগামহীনভাবে। সব মিলিয়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জনগনের ক্ষোভ দিনদিন বাড়ছে।