কী আছে সেই শরীফার গল্পে

টুইট ডেস্ক : সম্প্রতি একটি সেমিনারে পাঠ্যবইয়ের দুটি পাতা ছিঁড়ে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক খণ্ডকালীন শিক্ষক। নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের ওই দুই পাতায় হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক একটি পাঠ রয়েছে।

সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে একটি অধ্যায় আছে ‘মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা’। এই অধ্যায়ের একটি অংশে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত নেতিবাচক ধারনা থেকে কিশোরদের মধ্যে ইতিবাচকতা তৈরির লক্ষ্যে সচেতনতামূলক আলোচনা করা হয়েছে। আর এই আলোচনা হয়েছে একটি গল্পের মাধ্যমে। এটিই শরীফার গল্প।

কী আছে শরীফার গল্পে?

শরীফার গল্পটি শুরু হয় বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠা থেকে। এতে বলা হয়, ক্লাসে খুশি (শিক্ষক) আপা একজন অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। তিনি বললেন, ইনি ছোটবেলায় তোমাদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। আজ এসেছেন, নিজের স্কুলটা দেখতে। সুমন (শিক্ষার্থী) জানতে চাইল, আপনার নাম কী? তিনি বললেন, আমার নাম শরীফা আকতার।

শরীফা বললেন, যখন আমি তোমাদের স্কুলে পড়তাম তখন আমার নাম ছিল শরীফ আহমেদ। আনুচিং (শিক্ষার্থী) অবাক
হয়ে বলল, আপনি ছেলে থেকে মেয়ে হলেন কী করে?

শরীফা বললেন, আমি তখনও যা ছিলাম এখনও তাই আছি। নামটা কেবল বদলেছি। ওরা শরীফার কথা যেন ঠিকঠাক বুঝতে পারল না।

আনাই তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার বাড়ি কোথায়? শরীফা বললেন, আমার বাড়ি বেশ কাছে। কিন্তু আমি এখন দূরে থাকি। আনাই মাথা নেড়ে বলল, বুঝেছি, আমার পরিবার যেমন অন্য জায়গা থেকে এখানে এসেছে, আপনার পরিবারও তেমনি এখান থেকে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছে।

শরীফা বললেন, তা নয়। আমার পরিবার এখানেই আছে। আমি তাদের ছেড়ে দূরে গিয়ে অচেনা মানুষদের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছি। এখন সেটাই আমার পরিবার। তাদের অবাক হতে দেখে শরীফা এবার নিজের জীবনের কথা বলতে শুরু করলেন।

ছোটবেলায় সবাই আমাকে ছেলে বলত। কিন্তু আমি নিজে একসময় বুঝলাম, আমার শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও আমি মনে মনে একজন মেয়ে। আমি মেয়েদের মতো পোশাক পরতে ভালোবাসতাম। কিন্তু বাড়ির কেউ আমাকে পছন্দের পোশাক কিনে দিতে রাজি হতো না। বোনদের সাজবার জিনিস দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে সাজতাম। ধরা পড়লে বকাঝকা, এমনকি মারও জুটত কপালে।

মেয়েদের সঙ্গে খেলতেই আমার বেশি ইচ্ছে করত। কিন্তু মেয়েরা আমাকে খেলায় নিতে চাইত না। ছেলেদের সঙ্গে খেলতে গেলেও তারা আমার কথাবার্তা, চালচলন নিয়ে হাসাহাসি করত। স্কুলের সবাই, পাড়াপড়শি-এমনকি বাড়ির লোকজনও আমাকে ভীষণ অবহেলা করত। আমি কেন এ রকম, এ কথা ভেবে আমার নিজেরও খুব কষ্ট হতো, নিজেকে ভীষণ একা লাগত।

একদিন এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো যাকে সমাজের সবাই মেয়ে বলে কিন্তু সে নিজেকে ছেলে বলেই মনে করে। আমার মনে হলো, এই মানুষটাও আমার মতন। সে আমাকে বলল, আমরা নারী বা পুরুষ নই, আমরা হলাম তৃতীয় লিঙ্গ (থার্ড জেন্ডার)। সেই মানুষটা আমাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গেল, যেখানে নারী-পুরুষের বাইরে আরও নানা রকমের মানুষ আছেন।

তাঁদের বলা হয় ‌‘হিজড়া’ জনগোষ্ঠী। তাঁদের সবাইকে দেখেশুনে রাখেন তাঁদের ‘গুরু মা’। আমার সেখানে গিয়ে নিজেকে আর একলা লাগল না, মনে হলো না যে আমি সবার চেয়ে আলাদা। সেই মানুষগুলোর কাছেই থেকে গেলাম। এখানকার নিয়মকানুন, ভাষা, রীতিনীতি আমাদের বাড়ির চেয়ে অনেক আলাদা। আমরা সবার সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একটা পরিবারের মতনই থাকি। বাড়ির লোকজনের জন্যও খুব মন খারাপ হয়। তাই মাঝে মাঝে বাড়িতেও যাই।

আজ থেকে ২০ বছর আগে বাড়ি ছেড়েছি। সেই থেকে আমি আমার নতুন বাড়ির লোকদের সঙ্গে শহরের বিভিন্ন বাড়িতে গিয়ে, নতুন শিশু আর নতুন বর-বউকে দোয়া-আশীর্বাদ করে পয়সা রোজগার করি। কখনো কখনো লোকের কাছে চেয়ে টাকা সংগ্রহ করি। আমাদেরও ইচ্ছে করে সমাজের আর দশটা স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন কাটাতে, পড়াশোনা, চাকরি-ব্যবসা করতে। এখনো বেশির ভাগ মানুষ আমাদের সঙ্গে মিশতে চায় না, যোগ্যতা থাকলেও কাজ দিতে চায় না।

তবে আজকাল অনেক মানুষ আমাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। ইদানীং আমাদের মতো অনেক মানুষ নিজ বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করছে। আমাদের মতো মানুষ পৃথিবীর সব দেশেই আছে। অনেক দেশেই তারা সমাজের বাকি মানুষের মতনই জীবন কাটায়। তবে আমাদের দেশের অবস্থারও বদল হচ্ছে। ২০১৩ সালে সরকার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে।

বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য কাজ করছে। শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রচেষ্টা নিচ্ছে। নজরুল ইসলাম ঋতু, শাম্মী রানী চৌধুরী, বিপুল বর্মণের মতো বাংলাদেশের হিজড়া জনগোষ্ঠীর অনেক মানুষ সমাজজীবনে এবং পেশাগত জীবনে সাফল্য পেয়েছেন।

বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় এই গল্পের পর ৪১ পৃষ্ঠায় কর্মক্ষেত্রে সফল কয়েকজন হিজড়ার ছবি দেয়া হয়েছে।

তারপর ‌‘নতুন প্রশ্ন’-তে বলা হয়েছে, ওরা (শিক্ষার্থী) এতদিন জানত, মানুষ ছেলে হয় অথবা মেয়ে হয়। এখানেও যে বৈচিত্র্য থাকতে পারে, সে কথা ওরা কখনো শোনেনি, ভাবেওনি। কিন্তু শরীফা আলাদা রকম বলে সবাই তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে, এমনকি তার পরিবারের লোকেরাও! শরীফার জীবনকাহিনি শুনে সবার মন এমন বিষাদে ডুবে গেল যে তাকে আর বেশি প্রশ্ন করতেও ইচ্ছে করল না।

এরপর শিক্ষার্থীরা সেদিন বাড়ি ফেরার পথে বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। এতে নানা প্রশ্নের মাধ্যমে শেখার অংশ রয়েছে।

এই গল্পের মাধ্যমে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে গত শুক্রবার (১৯ জানুয়ারি) এক সেমিনারে অভিযোগ তোলেন শিক্ষক আসিফ মাহতাব। জাতীয় শিক্ষক ফোরাম আয়োজিত সেমিনারের শিরোনাম ছিলো ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’।

বক্তব্য দেয়ার সময় সেমিনারে অংশগ্রহণকারীদের ৮০ টাকা দিয়ে বইটি বাজার থেকে কিনতে বলেন মাহতাব। পরে বইয়ের ট্রান্সজেন্ডারের গল্প থাকা দুটি পাতা ছিঁড়ে আবার দোকানে ফেরত দেয়ার পরামর্শ দেন।

ওই ঘটনার ভিডিও পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়। আসিফ মাহতাবের দাবি, বইয়ে ট্রান্সজেন্ডার ও তৃতীয় লিঙ্গ নিয়ে ভুল তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ফলে এই তথ্যের প্রতিবাদে দেয়া তার সেই বক্তব্যে তিনি এখনও অনঢ়।

সময় সংবাদকে তিনি বলেন, প্রেক্ষাপটটা ছিল ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু, যেটাকে হিজড়ার সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। আমি অনেক আগে থেকেই হিজড়াদের অধিকার নিয়ে লিখেছি, তাদের পক্ষে কথা বলেছি। কিন্তু ট্রান্সজেন্ডার যখন হিজড়াদের অধিকার নিয়ে যায়, আর তার থেকেও ভয়ঙ্কর হচ্ছে, বাচ্চাদের ট্রান্সজেন্ডার আদর্শ পড়িয়ে মগজ ধোলাই করা হচ্ছে।

এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে সোমবার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এক বিবৃতি দিয়ে জানায়, আসিফ মাহতাব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তাঁর সঙ্গে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো চুক্তি নেই। এতে আরও বলা হয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তি এবং সহিষ্ণুতা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এদিকে চাকরি হারানোর বিষয়টিকে বৈষম্যমূলক আচরণ বলেও মন্তব্য করেন মাহতাব। বলেন, আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। কারণ, আমার ক্লাস দেয়া আছে, কোন দিন কোন ক্লাস নেবো সব ঠিক থাকার পর হঠাৎ আমাকে ক্লাসে আসা লাগবে না- এটা বৈষম্যমূলক আচরণ ছাড়া আর কিছুই না।

এই বিষয় নিয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখোমুখি হন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন, পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক পাঠ অংশের উপস্থাপনায় কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হলে এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করলে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে।

তবে বইয়ে শব্দটি ট্রান্সজেন্ডার নয়, থার্ড জেন্ডার আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সেটি আইনত স্বীকৃত, যারা বায়োলজিক্যাল কারণে তৃতীয় লিঙ্গ বা সামগ্রিকভাবে সমাজে হিজড়া নামে পরিচিত। তারা এ দেশের নাগরিক। অবশ্যই তাদের নাগরিক সুবিধা আছে।

পাশাপাশি মন্ত্রী এটাও স্মরণ করিয়েছেন, দেশে একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে নানা বিষয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে বা ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে নানা সময়ে অরাজকতা করার বা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার প্রবণতা আছে।