খালেদা জিয়া: ইতিহাসে গড়েছেন বিরল নজির

জনগণের রায়ে অটুট বিশ্বাস: ক্ষমতার পালাবদল হলেও অক্ষুণ্ন থেকেছে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত বিজয়ের ধারা
বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশের রাজনীতির দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল ইতিহাসে কিছু নাম সময়কে অতিক্রম করে স্মৃতিতে স্থায়ী হয়ে থাকে। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম—যিনি শুধু ক্ষমতার রাজনীতি নয়, বরং নির্বাচনী ইতিহাসে রেখে গেছেন এক অবিস্মরণীয় ও অপরাজিত অধ্যায়।
যতবার তিনি জনগণের রায়ে নিজের ভাগ্য নির্ধারণের লড়াইয়ে নেমেছেন, প্রতিবারই ফিরে এসেছেন বিজয়ের মুকুট পরে। কোনো নির্বাচনী আসনেই তাকে পরাজয়ের স্বাদ নিতে হয়নি—বাংলাদেশের রাজনীতিতে যা এক বিরল ও অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
১৯৯১ সাল। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসানের পর নতুন করে গণতন্ত্রের সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রাজনীতির মঞ্চে দৃপ্ত পদচারণা শুরু হয় বেগম খালেদা জিয়ার। পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি একযোগে পাঁচটি আসন—বগুড়া-৭, ঢাকা-৫, ঢাকা-৯, ফেনী-১ ও চট্টগ্রাম-৮—থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই বিপুল ভোটে জয়ী হন। সেই জয় শুধু নির্বাচনী বিজয় ছিল না; ছিল এক নারীর নেতৃত্বে জাতির নতুন প্রত্যাশার প্রতিফলন। বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন—যা দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত হয়ে ওঠে।
১৯৯৬ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেও তার নির্বাচনী অগ্রযাত্রা থেমে থাকেনি। ১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধীদলগুলোর বয়কটের মাঝেও তিনি পাঁচটি আসন—বগুড়া-৬, বগুড়া-৭, ফেনী-১, লক্ষ্মীপুর-২ ও চট্টগ্রাম-১—থেকে নির্বাচন করে প্রতিটিতেই জয়ী হন। যদিও সেই সরকার মাত্র ১২ দিনের মাথায় আন্দোলনের চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়, তবুও খালেদা জিয়ার অপরাজিত নির্বাচনী ধারায় কোনো ছেদ পড়েনি।
একই বছরের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলেও বেগম খালেদা জিয়া আবারও প্রমাণ করেন—জনগণের রায়ে তিনি অটুট। তিনি যে আসনগুলোতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন, সেগুলোতে পুনরায় বিজয়ী হয়ে নিজের রাজনৈতিক দৃঢ়তার সাক্ষর রাখেন।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল তার রাজনৈতিক জীবনের আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। চারদলীয় জোটের নেতৃত্বে তিনি পাঁচটি আসন—বগুড়া-৬, বগুড়া-৭, খুলনা-২, ফেনী-১ ও লক্ষ্মীপুর-২—থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতেই জয়ী হন। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে তিনি তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। সেই সময় তার নেতৃত্ব বিএনপিকে পৌঁছে দেয় ক্ষমতার শিখরে।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। জাতীয় রাজনীতিতে তখন ভিন্ন বাস্তবতা, ভিন্ন হাওয়া। তবুও বগুড়া-৬, বগুড়া-৭ ও ফেনী-১—এই তিনটি আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে তিনটিতেই জয়ী হন খালেদা জিয়া। দলীয়ভাবে পরাজয় এলেও ব্যক্তিগতভাবে তার অপরাজেয় ইতিহাস অটুট থাকে—যেন জনগণের ভালোবাসা তাকে ঘিরে রেখেছিল নীরব অথচ দৃঢ় প্রতিশ্রুতিতে।
সব মিলিয়ে ১৯৯১, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি ও জুন), ২০০১ ও ২০০৮—এই পাঁচটি নির্বাচনে প্রায় ২৩টি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিটি আসনেই জয়ী হন তিনি। এরপর ২০১৪ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন বিএনপি বয়কট করে। ২০১৮ সালে মামলাজনিত দণ্ডের কারণে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি।
২০২৫ সালে সব মামলায় খালাস পাওয়ার পর আবারও নির্বাচনী রাজনীতিতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। ২০২৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে তার সমর্থকদের মনে জেগে উঠেছিল নতুন আশা। কিন্তু নিয়তির অমোঘ ডাকে সেই প্রত্যাবর্তন আর বাস্তবায়িত হয়নি।
তার প্রয়াণে বাংলাদেশ হারিয়েছে এক দৃঢ়চিত্ত নেতা, আর নির্বাচনী ইতিহাস হারিয়েছে এক অপরাজিত অধ্যায়। বেগম খালেদা জিয়ার নাম তাই কেবল একটি রাজনৈতিক পরিচয় নয়—এটি হয়ে থাকবে সাহস, সংগ্রাম ও জনগণের রায়ে গড়া এক অমর স্মৃতি।





