সংগ্রাম ও সাহসের নাম বেগম খালেদা জিয়া

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনী। এক নারীর উত্থান, এক জাতির স্মৃতি: বেগম খালেদা জিয়ার পথচলা।
বদিউল আলম লিংকন: বেগম খালেদা জিয়া (জন্ম: ১৫ আগস্ট ১৯৪৫ – মৃত্যু: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫) বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কালজয়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত।
তিনি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে আপোষহীন নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তার রাজনৈতিক জীবন ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি থেকে শুরু হয়ে জাতীয় নেতৃত্বে উন্নীত হয়েছে।
খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের দিনাজপুর জেলায় (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে) এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইস্কান্দার মজুমদার এবং মাতা তৈয়বা মজুমদার। ১৯৬০ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অফিসার জিয়াউর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর তিনি একজন গৃহিণী হিসেবে জীবনযাপন করেন এবং দুই পুত্র – তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো – এর জননী হন।
১৯৮১ সালের ৩০ মে স্বামী জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর খালেদা জিয়ার জীবন আমূল বদলে যায়। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তার মৃত্যুর পর দলের নেতারা খালেদা জিয়াকে নেতৃত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন। ১৯৮২ সালে তিনি বিএনপিতে যোগদান করেন এবং ১৯৮৪ সালে দলের চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। এভাবে একজন সাধারণ গৃহবধূ থেকে তিনি রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম
১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দেন। তিনি আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনাসহ অন্যান্য দলের সাথে জোট গঠন করে ১৯৯০ সালে এরশাদের পতন ঘটান। এই আন্দোলনে তার আপোষহীন ভূমিকা তাকে “আপোষহীন নেত্রী” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন
১৯৯১-১৯৯৬: প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি অর্থনৈতিক উদারীকরণ নীতি গ্রহণ করেন, যা দেশের অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করে।
নারী শিক্ষার প্রসারে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ: মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক পর্যায়ে অবৈতনিক শিক্ষা এবং উপবৃত্তি চালু করেন, যা নারী শিক্ষার অগ্রগতিতে মাইলফলক হয়ে ওঠে।
২০০১-২০০৬: দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী। এ সময় দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতি লাভ করে।
খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক জীবনে কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি একাধিক আসন থেকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন।
পরবর্তী সংগ্রাম এবং কারাবাস
২০০৭-২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তিনি গ্রেফতার হন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের হয়। ২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তিনি ১৭ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত হন। তিনি এই মামলাগুলোকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে অভিহিত করেন। দীর্ঘ কারাবাস এবং স্বাস্থ্যগত কারণে ২০২০ সালে তাকে হাউস অ্যারেস্টে রাখা হয়।
২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর তিনি মুক্তি লাভ করেন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সুপ্রিম কোর্ট তাকে সকল মামলায় খালাস দেন।
স্বাস্থ্য সমস্যা এবং মৃত্যু
দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, হৃদরোগসহ একাধিক জটিল রোগে ভুগছিলেন খালেদা জিয়া। ২০২৫ সালের নভেম্বর থেকে তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ সকাল ৬টায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তার মৃত্যুতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং বলেন, “বেগম খালেদা জিয়ার ইন্তেকালে জাতি তার এক মহান অভিভাবককে হারাল।”
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নারী ক্ষমতায়ন এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতীক। তার নেতৃত্বে বিএনপি দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। তার প্রয়াণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি যুগের অবসান ঘটল, কিন্তু তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।





