ধেয়ে আসছে শৈত্যপ্রবাহ ‘কনকন’: তাপমাত্রা নামতে পারে ৬–৮ ডিগ্রিতে

উত্তর দিকের হিমেল বাতাস, উচ্চচাপ বলয় ও কুয়াশার প্রভাবে দেশে শীতের তীব্রতা বাড়ছে।
টুইট প্রতিবেদন: দেশজুড়ে শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকায় নতুন করে আতঙ্ক তৈরি করেছে আসন্ন শৈত্যপ্রবাহ ‘কনকন’। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এই শৈত্যপ্রবাহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।
বাংলাদেশ ওয়েদার অবজারভেশন টিম (বিডব্লিউওটি) জানিয়েছে, শৈত্যপ্রবাহের প্রভাবে তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা চলতি মৌসুমে অন্যতম শীতল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
বিডব্লিউওটির পূর্বাভাস অনুযায়ী, ‘কনকন’ শৈত্যপ্রবাহ ২৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। কিছু পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর থেকে এর তীব্রতা আরও বাড়তে পারে।
সংস্থাটির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে একে “তীব্র শৈত্যপ্রবাহ” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে হালকা শৈত্যপ্রবাহ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
শৈত্যপ্রবাহের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে। এছাড়া রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেটসহ মধ্যাঞ্চলের ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ এবং পূর্বাঞ্চলের কুমিল্লা, চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেও তীব্র শীত অনুভূত হবে। উপকূলীয় এলাকা চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে শীত থাকলেও শৈত্যপ্রবাহের তীব্রতা তুলনামূলক কম থাকতে পারে।
বিডব্লিউওটির হিসাব অনুযায়ী, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, যশোর, নড়াইল, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, পাবনা, নাটোর, বগুড়া, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ ও রাজবাড়ী অঞ্চলে তাপমাত্রা ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যেতে পারে। উত্তরাঞ্চলে ইতোমধ্যে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১১ ডিগ্রির ঘরে নেমেছে, যা আগের দিনের তুলনায় আরও কম।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, শৈত্যপ্রবাহের সঙ্গে ঘন কুয়াশা অব্যাহত থাকবে, ফলে শীতের অনুভূতি আরও বাড়বে। বিশেষ করে সকাল ও রাতের দিকে দৃশ্যমানতা কমে যেতে পারে, যা সড়ক ও নৌযান চলাচলে ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। আবহাওয়া বিশ্লেষকদের মতে, পৌষ মাসের মাঝামাঝি সময়ে শৈত্যপ্রবাহ সর্বোচ্চ তীব্রতায় পৌঁছাতে পারে।
শৈত্যপ্রবাহের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে শিশু, বয়স্ক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ফেডারেশন (আইএফআরসি) জানিয়েছে, শীতজনিত শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে। এ অবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে শীতার্তদের সহায়তায় প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
আবহাওয়া সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সাধারণ মানুষকে উষ্ণ পোশাক ব্যবহার, ভোর ও গভীর রাতে অপ্রয়োজনে বাইরে না যাওয়া এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে। পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা হচ্ছে, এবং নতুন তথ্য অনুযায়ী পূর্বাভাস হালনাগাদ করা হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশে শৈত্যপ্রবাহের প্রধান কারণ হলো উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে আসা হিমেল ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ। হিমালয় ও আশপাশের পাহাড়ি অঞ্চলে শীতকালে বিপুল পরিমাণ ঠান্ডা বায়ু জমা হয়। এই ঠান্ডা বায়ু উত্তর দিক থেকে নেমে এসে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, বিশেষ করে রংপুর ও রাজশাহী অঞ্চলের ওপর দিয়ে, যার ফলে অল্প সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়।
বাংলাদেশে শৈত্যপ্রবাহের কারণসমূহ
শীতকালে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ এলাকায় একটি শক্তিশালী উচ্চচাপ অঞ্চল তৈরি হয়। এই উচ্চচাপ ব্যবস্থা ঠান্ডা ও শুষ্ক উত্তরীয় বাতাসকে বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। এর ফলে দেশের ভেতরে বাতাসের আর্দ্রতা কমে যায় এবং শীতের তীব্রতা বেড়ে শৈত্যপ্রবাহের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে উৎপন্ন ওয়েস্টার্ন ডিস্টার্ব্যান্সও শৈত্যপ্রবাহ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব আবহাওয়াগত ব্যবস্থা উত্তর ভারত অতিক্রম করে কখনো বৃষ্টি, কখনো ঘন কুয়াশা সৃষ্টি করে এবং কখনো অতিরিক্ত ঠান্ডা বায়ু নিয়ে আসে, যা বাংলাদেশের ওপর শৈত্যপ্রবাহকে আরও তীব্র করে তোলে।
শীতকালে রাতের বেলায় আকাশ পরিষ্কার থাকলে পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে দ্রুত তাপ বিকিরণ ঘটে, যাকে রেডিয়েশনাল কুলিং বলা হয়। এর ফলে রাতের তাপমাত্রা দ্রুত নেমে যায়। পাশাপাশি ঘন কুয়াশা সূর্যের আলো বাধাগ্রস্ত করে দিনের বেলায় তাপমাত্রা বাড়তে দেয় না, ফলে শীতের অনুভূতি আরও তীব্র হয়।
ভৌগোলিক অবস্থানও শৈত্যপ্রবাহের তীব্রতার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হিমালয়ের তুলনামূলক কাছাকাছি এবং সমুদ্র থেকে দূরে হওয়ায় ঠান্ডা বাতাসের প্রভাব সেখানে বেশি পড়ে। অন্যদিকে দক্ষিণ ও উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রের উষ্ণ প্রভাব থাকায় শৈত্যপ্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম তীব্র হয়।
এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শৈত্যপ্রবাহের ধরন বদলাচ্ছে। জেট স্ট্রিম ও পোলার ভরটেক্সের অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে হঠাৎ করে বেশি ঠান্ডা বায়ু দক্ষিণ এশিয়ার দিকে নেমে আসছে, যার কারণে বাংলাদেশে শৈত্যপ্রবাহ কখনো কখনো আরও তীব্র আকার ধারণ করছে।







