ঠান্ডায় কাবু রংপুরের খেটে খাওয়া মানুষ

টানা শৈত্যপ্রবাহে হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় বিপর্যস্ত হয়েছে রংপুরের নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষদের জীবনযাত্রা।

আব্দুল্লাহিল শাহীন (রংপুর): রংপুর বিভাগের টানা পাঁচ দিনেরও বেশি সময় ধরে চলমান শৈত্যপ্রবাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। হিমেল হাওয়া ও ঘন কুয়াশার সঙ্গে উত্তরাঞ্চলে ধেয়ে আসা নতুন শৈত্যপ্রবাহ ‘কনকন’-এর কারণে তাপমাত্রা নেমে এসেছে প্রায় ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এই হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ—দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক ও কৃষকরা।

রংপুর অঞ্চলে তাপমাত্রার চিত্র

চলমান শৈত্যপ্রবাহের প্রভাবে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায় তাপমাত্রা ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের আশপাশে ওঠানামা করছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সৈয়দপুরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে প্রায় ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তেঁতুলিয়ায় ১১ দশমিক ৬ ডিগ্রি এবং ডিমলায় ১২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, শৈত্যপ্রবাহ আরও তীব্র হলে আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা ৭ থেকে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসতে পারে।

কেন রংপুরে শীতের প্রভাব বেশি

রংপুর অঞ্চলে শীতের তীব্রতা অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি হওয়ার পেছনে রয়েছে ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক কয়েকটি কারণ। রংপুর বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় বিভাগ হওয়ায় এটি হিমালয় পর্বতমালার তুলনামূলকভাবে কাছাকাছি অবস্থান করছে। ফলে শীতকালে হিমালয় থেকে আসা ঠান্ডা উত্তরীয় বাতাস সরাসরি এই অঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করে, যার ফলে তাপমাত্রা দ্রুত কমে যায়।

এ ছাড়া শীতকালে দীর্ঘ সময় ধরে ঘন কুয়াশা ও হিমেল হাওয়া বিরাজ করে রংপুরের চরাঞ্চল ও খোলা এলাকায়। সূর্যের আলো ঠিকমতো পৌঁছাতে না পারায় দিনের বেলায়ও তাপমাত্রা বাড়ে না। তিস্তা, ঘাঘটসহ নদী ও বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলের আধিক্যের কারণে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে, যা শীতের অনুভূতিকে আরও তীব্র করে তোলে।

থমকে গেছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন

শীতের তীব্রতায় শিশু, দিনমজুর, রিকশাচালক, ভ্যানচালক ও কৃষকদের দৈনন্দিন জীবন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘন কুয়াশায় চারপাশ ঝাপসা থাকায় মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে যান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ফলে শ্রমজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীরা সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছেন না।

ভোরে কাজে বের হওয়া অনেকের জন্যই কঠিন হয়ে পড়েছে। পর্যাপ্ত শীতবস্ত্রের অভাবে কাঁপতে কাঁপতে কাজ করছেন অনেকে, আবার কেউ কেউ কাজ না পেয়ে বাধ্য হয়ে ঘরে বসে থাকছেন। এতে দৈনিক আয় কমে যাওয়ায় পরিবার চালানো নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে।

শীতবস্ত্রের দোকানে ভিড়, তবু খালি হাতে ফেরা

তারাগঞ্জ উপজেলার বাজারে শীতবস্ত্রের দোকানগুলোতে ভিড় বাড়লেও উচ্চ দামের কারণে অনেকেই খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন। দিনমজুর মতিউর রহমান বলেন, “ছেলেমেয়ে আর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য গরম কাপড় কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু দাম বেশি হওয়ায় শুধু এক বাচ্চার জন্য কিনে ফিরছি। বাকিদের জন্য টাকা নেই।”

বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি

শীতের প্রকোপে শিশু ও বয়স্কদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে স্থানীয় হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে। সন্ধ্যার পর শীত আরও তীব্র হলে রাস্তার পাশে কিংবা খোলা আকাশের নিচে অসহায় মানুষদের আগুন পোহাতে দেখা যায়। কুর্শা ইউনিয়নের রিকশাচালক আলমগীর হোসেন বলেন, “গত কয়েক দিন প্রচণ্ড ঠান্ডায় রিকশা চালাতে পারছি না। সংসার চালানো খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

সহায়তা প্রয়োজন আরও বেশি

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, এই শৈত্যপ্রবাহ জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে এবং রংপুর বিভাগে তাপমাত্রা আরও কমার আশঙ্কা রয়েছে। জেলা প্রশাসন ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ শুরু করলেও চাহিদার তুলনায় তা এখনো অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

চরম শীতের মধ্যেও খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযুদ্ধ থেমে নেই। তবে এই দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে আরও ব্যাপক সহায়তা ও মানবিক উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করছেন সচেতন মহল। স্থানীয় বাসিন্দারা শীতার্ত মানুষের সহায়তায় সরকারি ও বেসরকারি সব মহলের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।