কানাইজো পাহাড়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্ত হয় বান্দরবান

যেভাবে হানাদারমুক্ত হয় বান্দরবান

অসীম রায় (অশ্বিনী): ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বান্দরবান পার্বত্য জেলা (তৎকালীন বান্দরবান মহকুমা) হানাদারমুক্ত হয়েছিল ১৪ ডিসেম্বর—দেশের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র একদিন আগে। এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়, যা বান্দরবানকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করে।

এই ঘটনা না কেবল পার্বত্য অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের সাক্ষ্য বহন করে, বরং স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় চলা যুদ্ধ, শহীদদের ত্যাগ এবং স্থানীয় নেতৃত্বের ভূমিকা এই অধ্যায়কে অমর করে রেখেছে।

মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধের শুরু

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের পর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বান্দরবানের পাহাড়ি অঞ্চলে হানাদার বাহিনী অবস্থান নিয়েছিল, কিন্তু স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা এবং ইপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে যুদ্ধ শুরু হয় বর্তমান রোয়াংছড়ি উপজেলার নোয়াপতং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আন্তাহা পাড়া এবং কানাইজো পাহাড়ি এলাকায়। এখানে মুক্তিযোদ্ধারা দুর্গম গহিন অরণ্যে হানাদারদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালান।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুসারে, ১৫ নভেম্বর সারা রাত ধরে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তীব্র যুদ্ধ চলে। পরদিন ১৬ নভেম্বর ভোর ৪টায় হানাদাররা আক্রমণ চালায়। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ইপিআরের সুবেদার মেজর তাহের মোহাম্মদ আলী (ওরফে টিএম আলী), যিনি অবাঙালি-বিহারি ছিলেন কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন। প্রায় চার ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর সকাল ৮টায় যুদ্ধ থামে, কিন্তু এতে শহীদ হন টিএম আলী। তাঁর শহীদ হওয়া স্থান কানাইজো পাড়ায় স্থানীয় গ্রামবাসী মং চউ মারমার তথ্যমতে যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধের পর বান্দরবানের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা একত্রিত হয়ে হানাদারদের বিতাড়িত করতে থাকেন।

হানাদারমুক্ত ঘোষণা এবং পতাকা উত্তোলন

১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বান্দরবান পুরোপুরি হানাদারমুক্ত হয়। এই দিনে তৎকালীন বান্দরবান মহকুমা প্রশাসক শুক্কুর আলী, বান্দরবান বোমাং সার্কেল চিফ বোমাংগ্রী রাজা মংশৈ প্রু চৌধুরী এবং স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুবল চন্দ্র মুহুরীর নেতৃত্বে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। পতাকা উড়ানো হয় মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে (বর্তমান পানি উন্নয়ন বোর্ড কার্যালয়) এবং বর্তমান জিরো পয়েন্টে (তখনকার এসডিও বাংলো)। এর মধ্য দিয়ে বান্দরবানকে হানাদারমুক্ত ঘোষণা করা হয়। এই ঘটনা দেশের অন্যান্য জেলা যেমন জয়পুরহাট এবং সিরাজগঞ্জের সঙ্গে সমান্তরালভাবে ঘটে, যা ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ের পথ প্রশস্ত করে।

বান্দরবান জেলায় স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ একমাত্র খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা টিএম আলী (বীর প্রতীক)। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে শহীদ হওয়া স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি দীর্ঘদিনের। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের আহ্বায়ক ক্যাপ্টেন (অব.) আবুল কাশেম চৌধুরী বীর প্রতীক এই দাবি জানিয়েছেন।

সাম্প্রতিক উদযাপন এবং কর্মসূচি

১৪ ডিসেম্বর বান্দরবান হানাদারমুক্ত দিবস ও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, জেলা প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মধ্যে রয়েছে শহীদদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণ, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই দিবসকে আরও ব্যাপকভাবে উদযাপন করা হয়েছে, যাতে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শেখানো হয়।

২০২৪ সালে সারাবাংলা এবং অন্যান্য মিডিয়ায় এই দিবসের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা পাহাড়ি জেলার এই গৌরবময় অধ্যায়কে তুলে ধরে।

বান্দরবানের মুক্তিযুদ্ধের এই ইতিহাস পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের ঐক্য এবং ত্যাগের প্রতীক। এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার থেকে নতুন তথ্য উঠে আসছে, যা এই অধ্যায়কে আরও সমৃদ্ধ করে। সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনকে স্মৃতিসৌধ নির্মাণসহ এই ইতিহাস সংরক্ষণে আরও উদ্যোগী হওয়ার দাবি উঠছে।