ভাঙা সেতু দিয়ে আর কত দিন?

শিশুদের জীবন ঝুঁকিতে: নড়বড়ে সাঁকোই একমাত্র ভরসা।

অসীম রায় (অশ্বিনী): বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারী ইউনিয়ন। এখানে একটি ছোট্ট মেয়ে রিয়া, বয়স মাত্র আট বছর। প্রতিদিন সকালে বুকে বই চেপে ধরে বাড়ি থেকে বের হয় স্কুলের উদ্দেশে। কিন্তু তার পথে বাধা একটি ভাঙা সেতু—বাঁশ আর কাঠ দিয়ে তৈরি এক নড়বড়ে সাঁকো। এক পা ভুল হলেই নিচের পাহাড়ি ছড়ায় পড়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা। তবু যেতে হয়, কারণ অন্য কোনো পথ নেই।

এই দৃশ্য শুধু রিয়ার নয়, বাইশারী ও কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়া ইউনিয়নের হাজারো শিশু-কিশোরের প্রতিদিনের বাস্তবতা। গর্জনিয়া উত্তর বড়বিল–দক্ষিণ বাইশারী সংযোগ সেতুটি ২০১২ সালে পাহাড়ি ঢল আর বন্যায় ধ্বংস হয়ে যায়। তখন থেকে ১৩ বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু নতুন সেতু গড়ে ওঠেনি। তার বদলে রয়েছে একটি অস্থায়ী বাঁশের সাঁকো, যা সময়ের সাথে আরও জীর্ণ হয়ে উঠেছে। সামান্য বৃষ্টিতেই কেঁপে ওঠে, পাহাড়ি ঢলে মনে হয়—এই বুঝি শেষ।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. জমিরের কথায়, “১৩ বছর ধরে একটা ব্রিজ পড়ে আছে—এটা বিশ্বাসই হয় না। আমরা তো মানুষ, আমাদের জীবন কি এতই সস্তা?” কৃষক মো. ইউসুফ বলেন, “শাকসবজি ফলাই, বাজারে নিয়ে যাই। কিন্তু এই ব্রিজ না থাকায় ফসলই বোঝা হয়ে গেছে।” গর্জনিয়ার মো. সিরাজের হতাশা, “মাথায় করে সবজি নিয়ে সাঁকো পার হই। ভেঙে গেলে কয়েক দিন ঘরবন্দী।”

১৯৯৬ সালে নির্মিত এই সেতু একসময় দুই ইউনিয়নের প্রাণের সংযোগ ছিল। আজ ধ্বংসস্তূপ। স্থানীয়রা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পার্বত্য উন্নয়ন বোর্ড—সব দপ্তরে আবেদন করেছেন। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতা: সেতুটি কোন উপজেলার আওতায়? বাইশারী চেয়ারম্যান মো. আলম বলেন, জেলা পরিষদে আবেদন করা হয়েছে, কিন্তু অগ্রগতি নেই। ইউপি সদস্য নুরুল কবির লজ্জায় মুখ লুকান: “শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে, অথচ ১৩ বছরে কিছু হলো না।”

২০২৩ সালে এক শিক্ষার্থী সাঁকো থেকে পড়ে গুরুতর আহত হয়। চিকিৎসা নিয়েছে হাসপাতালে। তবু পরিবর্তন নেই।
২০২৫ সালেও একই চিত্র। সম্প্রতি গর্জনছড়া খালের অন্য এক সেতু ভারী বর্ষণে আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, মরণফাঁদে পরিণত। এলাকাবাসীর প্রশ্ন—দুই জেলার সীমান্তে পড়ে থাকা এই মানুষগুলোর কি কোনো ঠিকানা নেই? একটি সেতু কি চিরকাল ভাঙা পড়ে থাকবে?

এই অবহেলা শুধু যোগাযোগের সমস্যা নয়, এ শিশুদের শিক্ষা, কৃষকের জীবিকা, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার প্রশ্ন। প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ ছাড়া রিয়ার মতো হাজারো শিশু কত দিন এই মৃত্যুফাঁদ পার হয়ে স্কুল যাবে? দেখার কেউ কি সত্যিই নেই?