নির্বাচনের আগে ঋণখেলাপি যাচাইয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নির্দেশ

বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর তথ্য হালনাগাদ বাধ্যতামূলক। আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগ।

টুইট প্রতিবেদক: আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক মনোনয়নপত্র দাখিলকারী প্রার্থীদের ঋণখেলাপি তথ্য সঠিক, নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গভাবে প্রস্তুত করতে সকল বাণিজ্যিক ব্যাংককে কঠোর নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশনার মূল উদ্দেশ্য হলো নির্বাচনকালীন ঋণতথ্য যাচাই প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও নির্ভরযোগ্য করা, যাতে কোনো খেলাপি প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে।

৮ ডিসেম্বর, ২০২৫-এ প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ব্যাংকার্স সভায় এই নির্দেশনা পুনর্ব্যক্ত করেন এবং সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) কর্তৃপক্ষগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে আলোচনায় জোর দেন। এটি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সমন্বয় করে নেওয়া হয়েছে, যাতে প্রার্থীদের আর্থিক অবস্থানের প্রকৃত চিত্র উন্মোচিত হয়। নির্বাচনের সময়সূচি এখনও ঘোষণা করা হয়নি, কিন্তু ইসি ৭ ডিসেম্বর জানিয়েছিলেন যে, এটি এই সপ্তাহের মধ্যে (প্রথমার্ধ ডিসেম্বর) ঘোষণা করা হবে। নির্বাচন ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

তথ্য হালনাগাদ ও রিপোর্টিংয়ের উপর জোর

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংকগুলোকে সিআইবি ডেটাবেসে সকল ঋণতথ্য দ্রুত, সঠিক ও সম্পূর্ণভাবে আপডেট করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে—প্রার্থীদের খেলাপি অবস্থা নির্ধারণের জন্য সঠিক খেলাপির তথ্য, ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ পরিচয়মূলক তথ্য, সকল স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিবরণ এবং প্রতিটি অ্যাকাউন্টের হালনাগাদ রিপোর্ট।

বিআরপিডি (ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যান্ড পলিসি ডিপার্টমেন্ট) ও পরিদর্শন বিভাগের ঋণশ্রেণীকরণ নীতিমালা অনুসারে সব ঋণ সঠিক শ্রেণিতে রিপোর্ট করতে হবে। যদি কোনো ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ সিআইবিতে রিপোর্ট না থাকে, তা দ্রুত অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়েছে।

এছাড়া, ক্রেডিট কার্ডের নন-ট্রানজেকশনাল ফি (যেমন বার্ষিক ফি, লেট ফি) বকেয়া থাকলেও কাউকে খেলাপি দেখানো যাবে না। এমন কোনো গ্রাহককে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকলে শ্রেণীকরণ সংশোধন করতে হবে। এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) ও টিআইএন (করের সনদ) তথ্যও দ্রুত হালনাগাদ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কারণ এগুলো ছাড়া যাচাইয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আইনজীবী নিয়োগসহ ব্যবস্থা নিতে এবং নিষ্পত্তি বা মেয়াদোত্তীর্ণ মামলার আপডেট সিআইবিতে জানাতে বলা হয়েছে।

সর্বশেষ আপডেট অনুসারে, ৭ ডিসেম্বরের ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে বৈঠকে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এই নির্দেশনা পুনরাবৃত্তি করেন এবং ব্যাংকগুলোকে চিঠিপত্রের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। এছাড়া, নভেম্বর ১৫-এর নির্দেশে প্রত্যেক ব্যাংক শাখায় একজন নির্ধারিত অফিসার নিয়োগ করে তাদের নাম ও মোবাইল নম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা দিতে বলা হয়েছে, যাতে যাচাই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। দীর্ঘমেয়াদি খেলাপিদের ঋণ পুনর্নিদেশনা নিয়ম কঠোরভাবে মেনে চলতে এবং আদালতের স্টে অর্ডার থাকলেও প্রকৃত অবস্থা রিপোর্ট করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

খেলাপিদের প্রার্থিতা বাতিলের নিয়ম

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), ১৯৭২-এর ১২ অনুচ্ছেদ অনুসারে, মনোনয়নপত্র দাখিলের কমপক্ষে সাত দিন আগে ঋণ নিয়মিত না হলে প্রার্থিতা বাতিল হয়। কোম্পানির ডিরেক্টর বা ফার্মের পার্টনারদের ক্ষেত্রে এটি এক দিন আগে। সংশোধিত আদেশে বলা হয়েছে, নির্বাচিত হওয়ার পরও খেলাপি প্রমাণিত হলে বা মিথ্যা তথ্য দেওয়া প্রমাণিত হলে সংসদ সদস্যপদ বাতিল করা যাবে। নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা জানান, মনোনয়নপত্র যাচাইয়ের সময় ব্যাংকের তথ্যের সঙ্গে প্রার্থীর জমা তথ্য মিলিয়ে দেখা হয় এবং খেলাপি প্রমাণিত হলে রিটার্নিং অফিসার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন।

এই বছরের নির্বাচনে ইসি-এর চূড়ান্ত প্রস্তুতি সভায় (৩০ নভেম্বর) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ ও যাচাইয়ের জন্য একটি কৌশল ও কার্যপরিকল্পনা তৈরি করা হবে। এটি নির্বাচন নিরাপত্তা, লজিস্টিকস এবং শান্তি বজায় রাখার সঙ্গে যুক্ত।

পূর্ববর্তী নির্বাচনের অভিজ্ঞতা: ১১৮ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০২৪) ৩০০ আসনে দলীয় ও স্বতন্ত্র মিলে ২,৭১৩ জন মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। ইসি-এর অনুরোধে বাংলাদেশ ব্যাংক সিআইবি ডেটাবেস থেকে যাচাই করে অন্তত ১১৮ জনকে ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে। ফলে তাদের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। উদাহরণস্বরূপ, ৪ ডিসেম্বর ২০২৩-এ ঢাকার ১৫ আসনে ৬৪টি মনোনয়নপত্র বাতিলের মধ্যে অনেকগুলোই খেলাপির কারণে হয়। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবারের নির্দেশনা আরও কঠোর করা হয়েছে, যাতে তথ্যের অসঙ্গতি বা ম্যানিপুলেশন ঘটতে না পারে। ২০২৪-এর নির্বাচনে প্রায় ১,৪০০ জনের সিআইবি তথ্য অবৈধভাবে পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছিল, যা সিআইবি-এর ডিরেক্টরের অপসারণের কারণ হয়। এবার বাংলাদেশ ব্যাংক এমন কোনো অনিয়ম প্রতিরোধে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

ডিফল্ট লোনের সংকট ও সংস্কার

বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে ডিফল্ট লোনের পরিমাণ ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে—ডিসেম্বর ২০২৩-এ এটি ১.৪৫ লক্ষ কোটি টাকা (মোট ঋণের ৯.০৯%) ছিল। আইএমএফ-এর নির্দেশিকা অনুসারে ২০২৬ সালের মধ্যে এটি ৮%-এ নামাতে হবে। এই নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট উদ্যোগটি ডিফল্ট লোন পুনরুদ্ধারের একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ খেলাপিরা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হবে।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ৮ ডিসেম্বরের এক সেমিনারে জানান, ডিফল্ট সংকট মোকাবিলায় বিস্তৃত আইনি সংস্কার চলছে।যেমন-খেলাপিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, শেয়ার কনফিসকেট এবং বিদেশী সম্পদ পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক আইনি ফার্মের সঙ্গে চুক্তি। ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এ ৪৫টি সংশোধনীর খসড়া প্রস্তুত, যাতে ‘ওয়িলফুল ডিফল্টার’ শ্রেণীবিভাগ বিলুপ্তি এবং ব্যবসায়িক গ্রুপের সিস্টার কোম্পানিগুলোর ঋণ প্রাপ্তি সীমাবদ্ধতা অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, ব্যাংকের ডিরেক্টরদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে মন্ত্রী, সাংসদ বা স্থানীয় নেতাদের বহিষ্কারের প্রস্তাব রয়েছে। এই সংস্কারগুলো নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট যাচাইয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ব্যাংকিং সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নির্বাচন সময়সূচি ঘোষণার অপেক্ষায় ব্যাংকগুলো ডেটা আপডেটে তৎপরতা দেখা গেছে। ইসি-এর সর্বশেষ সভায় (১০ ডিসেম্বর) নির্বাচনের জন্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক এবং টিভি-রেডিওতে ঘোষণার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বিএনপি-এর মতো দলগুলো ২৩৭ জনের সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে কয়েকজন খেলাপি বলে সন্দেহ রয়েছে।

ব্যাংকাররা জানান, নভেম্বর থেকে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা সিআইবি ক্লিয়ারেন্সের জন্য হুড়োহুড়ি করছেন এবং আদালত থেকে স্টে অর্ডার নিয়ে আসছেন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর অবস্থান যে, স্টে অর্ডার থাকলেও প্রকৃত অবস্থা রিপোর্ট করতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে এই বিষয়ে আলোচনা সীমিত, কোনো উল্লেখযোগ্য ট্রেন্ড পাওয়া যায়নি। স্টক মার্কেট বা ব্যাংকিং সেক্টরে এর প্রভাব এখনও দৃশ্যমান নয়, তবে ডিফল্ট রিকভারির সম্ভাবনা বাড়ছে।

নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও অর্থনীতির উপর

এই নির্দেশনা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ করবে এবং খেলাপিদের রাজনীতিতে প্রবেশ বাধাগ্রস্ত করবে, যা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করবে। ব্যাংকিং সেক্টরে এটি ডিফল্ট লোন পুনরুদ্ধারকে ত্বরান্বিত করবে, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় সাহায্য করবে। তবে চ্যালেঞ্জ রয়েছে—তথ্যের অসঙ্গতি, রাজনৈতিক চাপ এবং আইনি জটিলতা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সফল বাস্তবায়ন হলে এটি ব্যাংকগুলোর গভর্ন্যান্স উন্নয়নে মাইলফলক স্থাপন করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগ নির্বাচনকে আরও জবাবদিহিমূলক করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদি তথ্য হালনাগাদ ও যাচাই সঠিকভাবে সম্পন্ন হয়, তাহলে প্রার্থীদের আর্থিক সততা নিশ্চিত হবে এবং ডিফল্ট সংকট মোকাবিলায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহে নির্বাচন সময়সূচি ঘোষণা এবং তথ্য যাচাইয়ের ফলাফল এই প্রক্রিয়ার সাফল্য নির্ধারণ করবে।