ভারতকে আবারও টার্গেট করে ট্রাম্পের শুল্ক হুশিয়ারি

ট্রাম্পের নতুন শুল্ক হুমকি: ভারতীয় চাল ও কানাডিয়ান সারকে টার্গেট করে আমেরিকান কৃষকদের রক্ষার চেষ্টা!
টুইট প্রতিবেদক: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ তারিখে হোয়াইট হাউসের ক্যাবিনেট রুমে অনুষ্ঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ রাউন্ডটেবল বৈঠকে আমেরিকান কৃষকদের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলারের কৃষি ত্রাণ প্যাকেজ ঘোষণা করেন। বৈঠকে ট্রাম্প বিশেষভাবে ভারত থেকে চাল এবং কানাডা থেকে সার আমদানিকে ‘ডাম্পিং’—অর্থাৎ কম দামে বাজারে পণ্য ঢুকিয়ে দেশীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত করা—অভিযোগে অভিযুক্ত করেন এবং নতুন শুল্ক আরোপের হুমকি দেন।
তিনি বলেন, “এই দেশগুলো আমাদের সুযোগ নিচ্ছে, এটা আর চলতে পারে না।” বৈঠকের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ট্রাম্প ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্টকে প্রশ্ন করেন, “ভারত কেন এটা করতে পারছে? তাদের তো শুল্ক দিতে হবে, চালে কোনো ছাড় আছে কি?” বেসেন্ট জবাবে জানান, “না স্যার, আমরা তাদের সঙ্গে ট্রেড ডিল নিয়ে কাজ করছি।” তখন ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলেন, “তারা ডাম্পিং করতে পারবে না।”
বৈঠকে লুইজিয়ানা–ভিত্তিক কেনেডি রাইস মিলের সিইও মেরিল কেনেডি ভারত, থাইল্যান্ড এবং চীনকে ‘প্রধান অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। তার অভিযোগ—এই দেশগুলো ভর্তুকি–সমর্থিত সস্তা চাল আমেরিকান বাজারে ঢুকিয়ে দেশীয় চালের দাম কমিয়ে দিচ্ছে।
এতে ট্রাম্প সরাসরি বলেন, “এটা খুব সহজ—শুল্ক আরোপ করে দুই মিনিটে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে।” আলোচনায় উঠে আসে যে ভারতীয় কোম্পানিগুলো আমেরিকান বাজারে শীর্ষ দুইটি খুচরা চাল ব্র্যান্ডের মালিক।
জবাবে ট্রাম্প বলেন, “আমরা এর যত্ন নেব।” একই সময়ে কানাডা থেকে সারের আমদানির বিষয়েও ট্রাম্প কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। তিনি বলেন, “এর অনেকটাই কানাডা থেকে আসে, এবং যদি দরকার হয় তাহলে আমরা খুব কঠোর শুল্ক লাগাব।”
তার এই মন্তব্য শুধু ভারত ও কানাডাকে নয়, বরং ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশকেও লক্ষ্য করে। দক্ষিণ আমেরিকার চাষিরা ইতোমধ্যে সস্তা আমদানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, যেখানে চালের বাজারদর কমে যাচ্ছে।
ট্রাম্প একই বৈঠকে ১২ বিলিয়ন ডলারের কৃষি ত্রাণ প্যাকেজের বিস্তারিত জানান। এই প্যাকেজে ১১ বিলিয়ন ডলার রো–ক্রপ (যেমন সয়াবিন, গম, মকাই, চাল) উৎপাদকদের এককালীন সহায়তা হিসেবে দেয়া হবে, যা ইউএসডিএ–র নতুন ‘Farmer Bridge Assistance’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিতরণ হবে। বাকি ১ বিলিয়ন ডলার অন্যান্য ফসলের জন্য বরাদ্দ থাকবে।
ট্রাম্প দাবি করেন, এই অর্থ শুল্ক রাজস্ব থেকেই আসবে, যা তার ভাষায় “ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।” তিনি আরও বলেন, “এই টাকা ছাড়া কৃষকরা ফসল বাজারে নিয়ে যেতে পারতেন না।” কৃষি সেক্রেটারি ব্রুক রোলিন্স জানান, নতুন এই ত্রাণ প্যাকেজ ২০২৫ সালের ফসল উৎপাদন স্থিতিশীল রাখতে এবং ২০২৬ সালের ফসলের প্রস্তুতিতে সাহায্য করবে।
তবে সমালোচকরা বলছেন, এই ত্রাণ মূলত ট্রাম্পের নিজস্ব ট্রেড ওয়ার–এর ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দেয়া হচ্ছে।
গত এক দশকে ভারত–আমেরিকা কৃষি বাণিজ্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ভারত যুক্তরাষ্ট্রে বাসমতি চাল, মশলা ও সামুদ্রিক পণ্য রপ্তানি করে; বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাদাম, তুলা ও ডাল আমদানি করে। তবে বিএসডব্লিউটি–তে ভর্তুকি, বাজার প্রবেশাধিকার এবং বিশেষ করে চাল ও চিনি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে।
২০২৫ সালের আগস্টে ট্রাম্প রাশিয়ান তেল কেনার অভিযোগে ভারতীয় পণ্যে ৫০% শুল্ক আরোপ করেছিলেন। তাই এবার চালকে লক্ষ্য করে শুল্ক হুমকি সেই ধারাবাহিকতারই অংশ। কানাডার ক্ষেত্রেও ইউএসএমসিএ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ট্রাম্প অতিরিক্ত ১০% শুল্কের হুমকি দিয়েছেন, যা সারের আমদানিকে সরাসরি প্রভাবিত করবে এবং আমেরিকান কৃষি উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়াতে পারে।
আজ ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নতুন কোনো শুল্ক আরোপ করেনি। তবে ট্রাম্পের মন্তব্য বিশ্বব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
ভারতের ইকোনমিক টাইমস, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস ও ইন্ডিয়া টুডে—সবাই শিরোনাম করেছে এটি “ট্রেড টেনশনের নতুন অধ্যায়।” সামাজিক মাধ্যমে ট্রাম্পের ‘ডাম্পিং’ মন্তব্য ভাইরাল, এক্স–এ ভিডিওগুলো হাজারো প্রতিক্রিয়া পেয়েছে। মার্কিন ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ অফিস থেকে রিক সুইটজারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ১০–১১ ডিসেম্বর ভারত সফর করছে বাইল্যাটারাল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট নিয়ে আলোচনা করতে।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এই বৈঠক থেকে তেমন অগ্রগতি নাও আসতে পারে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর অফিস এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে কানাডিয়ান কৃষকদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও সারের দাম সামান্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
ট্রাম্পের এই শুল্ক হুমকি আমেরিকান কৃষকদের কাছে ইতিবাচক সংকেত হিসেবে ধরা হলেও ভারতের চাল রপ্তানিকারকদের জন্য এটি বড় ঝুঁকি। যুক্তরাষ্ট্র ভারতের চাল রপ্তানির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার। আর কানাডার নিউট্রিয়েনসহ সারের প্রধান রপ্তানিকারক কোম্পানির বিনিয়োগ পরিকল্পনাও অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে। বৈশ্বিক ক্ষেত্রে এটি নতুন ট্রেড ওয়ার উসকে দিতে পারে—বিশেষ করে খাদ্যমূল্য ও মুদ্রাস্ফীতির সময়ে। ভারতের বাণিজ্য সচিব রাজেশ আগারওয়ালের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল আলোচনায় অংশ নিচ্ছে, যার ফল এই উত্তেজনা প্রশমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়—ট্রাম্পের এই হুমকি শুধু কৃষি খাত নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র–ভারত সম্পর্কেও নতুন জটিলতা তৈরি করেছে। যদি সত্যিই শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে বিএসডব্লিউটি–তে নতুন বিরোধ উত্থাপিত হতে পারে। আবার আলোচনায় অগ্রগতি হলে উত্তেজনা কমতে পারে।
কৃষকরা যেখানে স্বস্তি খুঁজছেন, বিশ্ববাজার এখনো অস্থির। আগামী কয়েক সপ্তাহের কূটনৈতিক আলোচনা এই সম্ভাব্য বাণিজ্য সংকটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।






